বিদুর ব্লগজিন : শতবর্ষে বীরেন্দ্র স্মরণ।। রাহুল পুরকায়স্থ


বেঁচে থাকার কবিতা
রাহুল পুরকায়স্থ

তিনি প্রেম লিখলেন, তিনি প্রতিবাদও লিখলেন। বাংলা কবিতা আরও রূপবান হয়ে উঠল— আর একটু রূপবান, এরকমটাই ভাবতাম। কিন্তু কেমন সে রূপ? কেমন রূপবান? তা তখনও ভাবিনি। আধ-খাওয়া চাঁদের নীচে বসে যখন সেই রূপ কল্পনায় ধরার চেষ্টা করি, কল্পনা ঝলসে যায়। ছায়া-অবনত মুখশ্রী দারুদগ্ধতা নিয়ে আহ্বান করে। আমি ভেসে যাই।
এও এক রকম বাংলা কবিতা এবং অবশ্যই রাজনৈতিক বাংলা কবিতা। যে অর্থে প্রতিটি কবিতাই রাজনৈতিক, তবে একটু প্রত্যক্ষ— যেভাবে প্রত্যক্ষ সূর্যের কিরণ আর প্রত্যক্ষ হবেই বা না কেন— জাতি দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতার লড়াই, দেশভাগ, পার্টি ভাগ, খাদ্য আন্দোলন, নকশাল বাড়ির আন্দোলন, জরুরী অবস্থা, বন্দীমুক্তি আন্দোলন তাঁর চলার পথের এক একটি নিশান—   যাদের তিনি সন্দেহ করেছেন, প্রশ্ন করেছেন কখনো কখনো সমর্পণ-সমর্থনও করেছেন। এ সমস্ত চিহ্ন সমূহ থেকে আহরণ করেছেন নিজের ভাষা —কবিতার ভাষা। সারাজীবন যে ভাষায় তিনি কথা বললেন, এখনো বলছেন, আরো বলবেনও। কেননা, তিনি সেই চন্দ্রলোকের বাসিন্দা, যে চাঁদ একাকী, যে চাঁদ যুবতী, যে চাঁদ মধ্য রাতে চুরি করে, যে চাঁদ চুরি করে ফাঁকা ট্রেনে দুর্ভিক্ষের চাল, একাকী যুবতী চাঁদ মধ্য রাতে ফাঁকা ট্রেনে চুরি করে দুর্ভিক্ষের চাল।
তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— লিখলেন আমাদের বেঁচে থাকার কবিতা। লিখলেন স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশী লেখা। লিখলেন যে কবিতা আমাদের বাঁচায়, বলে— বাঁচো বাঁচো। যে কবিতা দূর থেকে লক্ষ করে অন্যের বেঁচে থাকা। যে কবিতা আলিঙ্গন চায়, সমর্পণ চায়, সমর্থন চায় আর চায় জল— তৃষ্ণার জল :

তুমি সোনার কলস কাখে চলে যাও
আমি মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না।
                  
 ১৯৭৭-এ লিখলেন এই পংক্তি। মাটির পৃথিবীর দিকে তাঁর যাত্রা আরো গভীর। যে কবিতায় জীবনের লাবণ্য, মনুষ্যত্বের বহ্নি ও উৎসব, প্রতিবাদ থেকে যায়। তিনি অনুবাদও করলেন, অনুবাদ করলেন সেই সব কবিদের যাঁরা স্বপ্ন দেখে একটা চমৎকার পৃথিবীর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করলেন এক্সকিমো, পিগমি, গ্রীক, লাতিন, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, বাইবেল। অনুবাদ করলেন :

যদি মরতেই হয় শুয়োরের মত নয়
যাদের পেছনে শিকারীরা ক্ষ্যাপা কুকুরদের লেলিয়ে দেয়
তাড়া করে নিয়ে যায় অসম্মানের গহ্বরের দিকে
তারপর যাদের অভিশপ্ত ভাগ্যকে নিয়ে হাসতে হাসতে খুঁচিয়ে হত্যা করে

এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, কবিতার আজকের পাঠকেরা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পড়েন কিনা। তরুণ কবি আপনি? লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক আপনি? কলকাতার দাদাভজা সম্প্রদায়? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মঞ্চ লালিত বাংলার কবি সমাজের কি কখনো মনে পড়ে চিড়িয়াখানার সেই পংক্তিগুলি কিংবা আর এক আরম্ভের জন্যে সেই বিষাদ-ছোঁয়া অনুভব :

রক্তে নেই অচেতন
নাকি ঘুম সার্বাঙ্গে এখন মৃত্যুর মতই ক্রুদ্ধ
হায় রাত্রি, হায় রে যৌবন! 

আসলে এই প্রশ্নগুলি আমি আমাকেই করছি। যে-আমি স্পর্শ করতে চাই ঐ বিষন্নতাকে, ঐ হেরে-যাওয়া স্বপ্ন দেখা মানুষের বিষাদকে। আমি বিশ্বাস করি বিষাদই শিল্পের পিতা— আর ভয় পাই বিস্মরণের ভয়, আর ভয় পাই ফুল-মাল্যের ভয়। কেননা যাপনে নয়, উদযাপনে আমরা ক্রমশ গভীরতর হইতেছি। তবুও আনন্দের কথা— না, কোন প্রতিষ্ঠান নয়, কোন একাডেমি নয়, কোন সরকার নয়, কোন অনুপ্রেরণা নয়, আমরা যারা কবিতা ভালোবাসি, আমরা যারা কবিতার মধ্যে বাঁচি, কবিতার মধ্যে নিঃশ্বাস নিই— আমরা সবাই মিলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিবস পালন করছি। তবে যেটা বারবার ভয় লাগে— উদযাপনের ভয়। উদযাপনেই যাতে থেমে না থাকে, এই কবিতা— এই সব বাংলা কবিতা সমূহ যেন আমাদের দৈনন্দিনতার সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ— এটুকুই কবির জন্মশতবর্ষে আমার প্রত্যাশা, তাঁকে আমার প্রণাম। 

Comments