বিদুর ব্লগজিন : শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
অনর্থকোষ ✳
লেখা -১ 🎈
কী চমৎকার সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কবিতা এখন! রাস্তাঘাটে, না-চাইতেই দেখা হয়ে যাচ্ছে আমাদের। একা-একাই সে পাড়ি দিচ্ছে দেশ-বিদেশের নানান শহরে, আর অচেনা লোকজনের সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলছে বেশ।
আমি তার ঈষৎ পৃথুল ও লাবণ্যময় শরীরের ভাঁজগুলি, চিন্তিতমুখে, নিরীক্ষণ করি। ভাবি, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা, এই মুহূর্তে, উচিৎ হবে কি না।
লেখা -২ 🎭
খুঁটিয়ে দেখলে, ঠিকই বোঝা যায়। তোমার মুখের ওপর, অস্পষ্ট কতকগুলো অক্ষরের ছায়া। যেন একটা নকশা, বা প্যাটার্ণ, আস্তে-আস্তে দানা বাঁধছে। তাহলে কি, ওই প্যাটার্ণটাই রহস্য আসলে? যা ভেদ করতে পারলেই, দিনের আলোর মতন স্পষ্ট হয়ে উঠবে তোমার কপালের কাটা দাগ, গলার কাছে শুকিয়ে থাকা চাপ-চাপ রক্ত, আর বুকের ভেতর ডানা-ঝাপটানো উন্মাদ মৌমাছিগুলো? অথচ, অপেক্ষার কাল আর কিছুতে কাটে না। চারিদিক হাহাকারে ভারি হয়ে ওঠে। ভাবি,
কী এক দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা তোমার এই আশ্চর্য কেতাব! কে পড়ে শোনাবে?
নির্মাণ 🌄
তোমার কথা শুনতে-শুনতে, একসময়ে, আমি খেই হারিয়ে ফেলি। তোমার কথার চেয়েও, তোমার ঠোঁটের বাঁদিকে ওই কালচে-বাদামী তিলটির রহস্য উদ্ঘাটন করা, আমার কাছে বেশি জরুরি বলে মনে হতে থাকে। মনে হয়, অল্প-উঁচু চোয়ালের নড়াচড়া, গালের মাংসপেশীর কুঞ্চন, থুতনির ভাঁজ—এই সবকিছুর রহস্য যদি আগাগোড়া ভেদ করতে না-পারি, তাহলে তোমার কথার মর্মোদ্ধার কিছুতেই সম্ভব নয়।
অথচ, এতকিছু করতে গিয়ে, সময়ের খেয়াল থাকে না। সূর্য ডুবে গেলে তোমার মুখ, আচমকাই, একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়।
যোগাযোগ 🛩✈
আশ্চর্য জায়গা এই বিমানবন্দর! ঘুরেফিরে, বারবার, একই মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে থাকে—কফির দোকানে, রেস্তোরাঁয়, স্মোকিং রুমে, হিসি করতে গিয়ে,এমনকী,বিমানে ওঠার লাইনেও। অথচ, চোখাচোখি হলে, অনায়াসে মুখ ঘুরিয়ে নিই, যেন চিনতে পারিনি।কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।
বিমানবন্দর এক আশ্চর্য জায়গা বটে! অনিশ্চিত যাত্রার আগে, যখন অচেনা মানুষকেও খুব চেনা বলে মনে হয়। আর, ক্রমশ অচেনা হতে-হতে, আকাশের মসৃণ তলপেট ছুঁয়ে ভেসে থাকে চেনা মানুষজন।
স্তব্ধতা 🏬🏬
বরফ পড়ছিল। একটা সিগারেট খাব বলে, হোটেলের লাউঞ্জ ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। কাচের দরজা দিয়ে চুঁইয়ে আসা আলো, সামনের লনে, একটা লম্বা আয়তক্ষেত্র তৈরি করেছে। অথচ, তার বাইরে, চারিদিক অন্ধকার। এবং নিঃশব্দ। এখন, সেই অন্ধকার আস্তে-আস্তে শাদা হয়ে আসছে। ক্রমশ, শূন্যতাও শাদা হয়ে আসছে। স্তব্ধতার ভেতর কান পাতলে, একটা চাপা নিঃশ্বাসের মতো শব্দ। শোনা যায়। যদিও, হাওয়া তেমন নেই। মাঝেমধ্যে দূরে, হাইওয়ে দিয়ে, দ্রুতবেগে চলে-যাওয়া গাড়ির শিস। শোনা যায়।
—বুকের ভেতর, যেন কেউ নিচু হয়ে, জুতোর লেস বাঁধছে
—কোথাও কি যাওয়ার কথা ছিল, আমাদের
—ধূ ধূ প্রান্তরে বনের কেবলই তুষার ঝরছে, শুধুই তুষার
—একটা কয়েন, মাটিতে পড়ে, কোথায় গড়িয়ে যায়, কোনদিকে
—হেই ম্যান! অল ওয়েল? হোয়াট আ ফাকিং কোল্ড
বিদেশের শহরতলিতে, একটা তালা-বন্ধ আকাশের নীচে আমার এই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা, আমার সিগারেট ধরানো, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া টুকরো-টুকরো কথা, কবিতার লাইন—এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা যোগাযোগ আছে বলে মনে হয়। মনে হয়, আলোর কিনারা ঘিরে ওই যে অন্ধকার, আর আঁকাবাঁকা ছায়ার আঙুল, যেন এই সবকিছু নিয়েই একটা নকশা, একটা ছবি—অনেক পুরোন একটা ছবি—তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু—
লক্ষ করি, ওভারকোটের হাতায় আর কাঁধে গুঁড়ো-গুঁড়ো বরফ—স্যাঁতসেতে, ভিজে। ঝেড়ে ফেলি। আসলে তুষার, একটি অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা বা পরাগরেণুর চারিদিকে, জমে কঠিন হয়ে-যাওয়া জলীয় বাষ্পের স্ফটিক। এদের নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার রয়েছে, যার অনুপম নকশা ও সুক্ষ্ম কারুকার্য, যারপরনাই বিস্ময়কর। এবং শুনেছি, প্রত্যেকটি নকশাই নাকি আলাদা, অদ্বিতীয়। অথচ তা, খালিচোখে, দেখা যায় না।
দেখা যায় না, যে নিঃশব্দে এদিকে এগিয়ে আসছে, তাকেও। কিছুদূরে, নিষ্পত্র গাছগুলোর তলায়, একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে চমকে তাকাই। শীত করছিল। নাকের ডগা অসাড়। সিগারেট ফেলে দিয়ে, পুনরায়, ঢুকে পড়ি হোটেলের ভেতর। সেখানে এখন, আলো ও উত্তাপ ঘিরে, মানুষের কথাবার্তা, হুল্লোড়, হাসি, ক্রমশ জমাট বাঁধছে।
🌠 পরিচিতি
শৌভ চট্টোপাধ্যায় শূন্য দশকের কবি
জন্ম ও বেড়ে ওঠা : হাওড়ার শিবপুর
বর্তমানে কর্মসূত্রে বাসস্থান : দিল্লি
প্রথম কবিতা প্রকাশ : দেশ পত্রিকায়
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য
(ডি কোং, ২০০৯)
মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ
(নতুন কবিতা, ২০১৩)
মায়াকানন ( সৃষ্টসুখ, ২০১৬)
নিঃশব্দে অতিক্রম করি (শুধু বিঘে দুই, ২০১৯)
সম্পাদিত পত্রিকা : 'অবসরডাঙা' ও 'ব্রজী ' নামে পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুুক্ত ছিলেন।
Comments
Post a Comment