বিদুর।। সমীরের চটি : দেবজ্যোতি রায় পাঠ-প্রতিক্রিয়া : সেলিম মল্লিক
'সমীরের চটি' প্রসঙ্গে
মৃত্যু এক অদ্ভুত জিনিস। জন্ম থেকেই তাকে আমরা তাড়িয়ে নিয়ে চলেছি, একদিন তাকে আমরা ছুঁয়ে ফেলব, তখন খেলা শেষ। আবার এ-খেলার বিপরীত গতিও আছে, জন্ম থেকেই মৃত্যু আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে, কোনো এক শীতের ভোরে, কুয়াশার আড়াল থেকে, কিংবা ঘোর বর্ষায়, অথবা ভরাপূর্ণিমায়, বা খাঁ-খাঁ গ্রীষ্মের দুপুরে সে আমাদের ছুঁয়ে ফেলে। খেলা শেষ হয়। জীবন জুড়ে এই খেলার দর্শক আমরা, আবার খেলার সাথিও। এই খেলার অভিঘাত, মুদ্রা এবং রহস্য থেকে আমাদের মুক্তি নেই। সেই মৃত্যুই ধুলো, ছত্রাক, মাকড়সার জাল, কুয়াশা, গোধূলির ছায়া, দ্বাদশীর রাতের মতো ছুঁয়ে আছে 'সমীরের চটি'। 'সমীরের চটি' একটি ষোলো পাতার কবিতার বই, বারোটি না-অতি-দীর্ঘ কবিতার সংকলন। কবি দেবজ্যোতি রায়ের এখন পর্যন্ত প্রকাশিত শেষতম এবং তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ। ২০১৯ সালের শেষ পাদে বিদুর প্রকাশ করেছে বইটি।
বইটির বারোটি কবিতা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লক্ষ করলাম, প্রথম আটটি কবিতায় মৃত্যু বিষয় হয়ে রয়েছে, কিন্তু আটটি আলাদা আলাদা মাত্রা অনুষঙ্গ ও সময়ের পরিসরে। শেষ কবিতা, অর্থাৎ বইয়ের ১২ নম্বর কবিতাটিতে এমন এক 'ছন্দ'-কে জাগিয়ে তোলার আর্তি আছে, আছে এমন এক রূপময়তার বিন্যাস, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়িয়ে চলে। এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে, এই বই উৎসর্গ করা হয়েছে 'ছন্দকে'। 'ছন্দ' কে? জীবনের ছন্দ? না কি ছন্দ-নাম্নী উত্তরপুরুষ কেউ? শেষ কবিতা 'প্রজন্ম'-এ 'ছন্দ'-এর নাম আছে। যাই হোক-না-কেন, 'ছন্দ' যে যোগসূত্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 'ছন্দ' যেন শেষ থেকে আবার শুরুর প্রেরণা ও প্রবাহ। 'কাঠের শরীরে ডুবোজাহাজের ছন্দ লুকিয়ে রয়েছে', এই প্রত্যয়ে 'পালঙ্কের অবচেতনার দিকে চেয়ে' এমন স্বপ্ন দেখা সম্ভব হল, 'ছুতোরের ছেলে র্যাঁদা দিয়ে চোকলা তোলে, ছুতোরের নাতি র্যাঁদা দিয়ে চোকলা তোলে, কাঠ হেসে ওঠে'।
আর, শেষ কবিতাটির আগের অথবা প্রথম আটটি কবিতার পরের যে-তিনটি লেখা, সেসবে মৃত্যু কোনো স্পষ্ট বিষয় নয়, ভাব হয়ে, ইশারা হয়ে কাজ করেছে। এই তিনটি কবিতার একটি 'তোমার মনের কথা'। অন্য কবিতাগুলির মতো এটিও একাধিকভাবে পড়া যায়, অনেক দিক দিয়ে একে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই উপলক্ষে, এখানে আমার এক-রকম পাঠের কথা জানাই।
"তোমার মনের কথা অনুমান করে দিন কাটে
নতুনগঞ্জের পথে বিনোদ প্রভুকে বলি
আমাকে সঙ্গে নাও
মাধুকরী ফুরিয়ে এসেছে
মুদি দোকানের পাশে নিদ্রারত কুকুরের
উদাসীনতাকে বলি
আমাকে সঙ্গে নাও
দু-চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে
তোমার মনের কথা অনুমান করি
ফুসফুসে হাপরের ওঠাপড়া
পুড়ে যায় হলুদ পাখির ডানা
গ্রাম পার হয়ে নদীতীরে
বিদ্যুৎরেখায় দেখি
শ্মশানকালীর জিভে তোমার মনের কথা
লকলক করে।"
'তুমি' বাংলা কবিতায় এক সাংঘাতিক বস্তু। এবং এই 'তুমি'-কে নিয়ে কবিতায় রহস্যের শেষ নেই। সে কখনো ঈশ্বর, কখনো প্রেমিক-প্রেমিকা, কখনো এ-দুইয়ের আলোআঁধার, কখনো-বা আরও আরও অন্য কিছু, কখনো আবার একইসঙ্গে অনেক কিছুই। এই কবিতার শুরুই হচ্ছে এইরকম 'তুমি'-কে উপলক্ষ করে। আর যেহেতু এখানে 'তুমি'র 'মন' উল্লিখিত হয়েছে, তাই তাকে রক্তহীন অনুভূতিশূন্য দেবতা কিংবা ঈশ্বর ভেবে বসবার প্রত্যক্ষ সুযোগ নেই। তাকে মানবী মনে করাই স্বাভাবিক। [ বলে রাখা জরুরি যে, গোটা বইয়ের সমস্ত কবিতাই বস্তুতপক্ষে লৌকিক জমিনকেই অঙ্গীকার করে রূপ লাভ করেছে। ] পুরো কবিতার বয়ানটি আসলে উত্তম পুরুষে একজন পুরুষের কথন, যিনি, অনুমান করা যেতে পারে, সংসার ছেড়ে পালাতে চাইছেন। কিন্তু যিনি সংসারের মায়া ছিঁড়তে পারেননি তা সত্ত্বেও। তা সত্ত্বেও যিনি পালাতে চাইছেন সংসারের বাইরে।
এমন হয় জীবনে, শরীরের গ্রন্থি শিথিল হয়ে এলে বৈরাগ্য আসে। সশরীরে সম্ভব না হলেও, মানসিকভাবে বিষয়-আশয় অতিক্রম করে নির্ভার আশ্রমের আশ্রয় পেতে ইচ্ছে করে। শ্রীচৈতন্যর সময়কাল থেকেই এই মনোভাব বাঙালির বহুলাংশের বার্ধক্যের সহজ আকাঙ্ক্ষা অথবা বিলাস। আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থাকলে, সব ছেড়ে, ভোররাতের রমণীয় শয্যা ছেড়ে, অকাতরে চলে গিয়ে মিশে যেতে পারি অনন্ত পারাবারের নীলে। তা না-হলে সব ছাড়তে গিয়েও মায়া আঁকড়ে পড়ে থাকি, মায়া আঁকড়েও সব ছাড়ার পথ খুঁজি। এই কবিতার কথক ওই দ্বিতীয় দলের লোক। তার মাধুকরী ফুরিয়ে এসেছে। মাধুকরী মধুকরের তুল্য বৃত্তি। বৈষ্ণবদের নানা স্থান ঘুরে ঘুরে মধুকর ভ্রমরের মতো অন্ন জোগাড়ের নাম মাধুকরী। কিন্তু এই তাৎপর্যটিকে বেশি মূল্য দিতে ইচ্ছে করছে না এখানে। মধুকরের আরেক অর্থ--- বল্লভ বা প্রণয়ী। তাই মাধুকরী যেন প্রেমের মধু-সংগ্রহণ। আর তা ফুরিয়ে গেলে বেঁচে থাকা বিরস হয়ে ওঠে। তখন সংসার ও সংসারী অসহনীয় ঠেকে। কথক বলছে: "নতুনগঞ্জের পথে বিনোদ প্রভুকে বলি/ আমাকে সঙ্গে নাও"। কারণ, 'মাধুকরী ফুরিয়ে এসেছে'। 'প্রভু' গৌড়ীয় বৈষ্ণবতায় সন্ন্যাসের প্রাথমিক পদ। বিনোদ প্রভু চলেছেন নতুনগঞ্জের পথে, কথক, তাঁর সঙ্গে যেতে চাওয়ার আর্তি জানিয়েছে। কথকের দিক থেকে বৈরাগ্যের দিকে টান আছে। আছে, কারণ, জীবনের মাধুর্য যে মধুর রস, তা তার হয়তো ফুরিয়েছে। পুরুষজীবনের যে-মাধুরী পুষ্পপ্রতিমা নারী, তার হয়তো নেই আর। নেই মানে, সঙ্গে নেই, অঙ্গে নেই। তাই পুরোনো আশ্রম ছেড়ে 'নতুনগঞ্জে' যেতে মন চাইছে। বিনোদ প্রভুকে জানাচ্ছে নিজের আকুতি। এখানে বিশেষভাবে 'বিনোদ' পদটি নিয়ে ভাবা দরকার। বৈষ্ণবদের প্রিয় এই শব্দ। কিন্তু বৈষ্ণবতার বাইরে এনে দেখলে, এর থেকে দুটি অর্থ আমরা পেতে পারি, অনেক অর্থের মধ্যে বিশেষভাবে দুটি অর্থ--- 'বিহার' এবং 'সান্ত্বনা দান'। তবে কি বিনোদ প্রভু এমন এক ব্যক্তি, যিনি বিহারে চলেছেন? আর আমরা তো জানি, স্থবির নিঃসঙ্গ একঘেয়ে অবস্থা থেকে সাময়িক হলেও মুক্তি দিতে পারে বিহার, নতুন স্থানে বিহার। অথবা বিনোদ প্রভু কি এমন কেউ, যাঁর কাছ থেকে সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে, এই বীতরস জীবনকে সশরীরে আরও কিছু দিন বয়ে নিয়ে চলার? হয়তো।
এতসব ভাবছি বটে, কিন্তু কথক তবু মায়ায় আবদ্ধ। তার বয়ান শুরুই হয়েছে এভাবে: "তোমার মনের কথা অনুমান করে দিন কাটে"। এটাই তো স্বাভাবিক। আটপৌরে মানুষের স্বভাব তো এমনই। অন্তিম নিশ্বাসের সময় পর্যন্ত মায়া কুয়াশার মতো জড়িয়ে থাকে। তাই সে মন থেকে সংসার এবং সংসারের মাধুরীর স্মৃতিকে অতিক্রম করে চলে যেতে পারে না। তার প্রতি পারিপার্শ্বিকের উদাসীনতা লক্ষ করেও সে চলে যেতে পারে না। চোখের পাতা শুধু নয়, পায়ের পাতাও ভারী হয়ে আসে। মানুষি ভার সইতে না পেরে সে কখনো সামাজিক মনুষ্যেতর প্রাণীর নির্বিকার বেঁচে থাকার অনুগামী হতে চায়। এতকিছুর পরেও সে মনে মনে বলে: "তোমার মনের কথা অনুমান করি"। যদিও 'তোমার মনের কথা' কেমন, তা কবিতার চতুর্থ স্তবক পর্যন্ত এসেও নিশ্চিত করে বলতে পারা যায় না। অনুমান করা যেতে পারে, তা মন্দমধুর।
বিনোদ প্রভুর সঙ্গে চলে যাওয়া যে, আদতে সন্ন্যাসে যেতে চাওয়া নয়, তা যে আধ্যাত্মিকতার অভীষ্ট দেশে যেতে চাওয়ার বাসনা নয়, তার প্রমাণ, ঘুরেফিরে কথকের মনে অনুমিত হচ্ছে কোনো একজনের মনের কথা। কিন্তু আধ্যাত্মিকের 'স্মরণে ধ্যেয় বিষয়ের অনুচিন্তন থাকে' সারাক্ষণ, আর-সব চিন্তা পরিত্যাজ্য। সেখানে ধ্যেয় শুধু ঈশ্বর। আর এখানে ধ্যেয় 'তুমি'। এবং চিন্তায় প্রবাহিত 'তোমার মনের কথা', যা ভাবতে ভাবতে বুকের তলায় ফুসফুস কামারশালের হাপরের মতো উঠতে-পড়তে থাকে, তাতে চেগে ওঠে আশ্চর্য প্রদাহ, যাতে 'পুড়ে যায় হলুদ পাখির ডানা'। বলা বাহুল্য, বাঙালি লোকজীবনে 'হলুদ পাখি', প্রধানত প্রণয়-পরিণয়ের দ্যোতনা বয়ে আনে।
শেষ স্তবকে এসে যেন স্পষ্ট হল 'তোমার মনের কথা'। সংসার ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাওয়া মানুষ, পালাতে গিয়ে, গ্রামজনপদ পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে নদীতীরে। নদী যেন 'তোমাকে' পেরিয়ে যাওয়ার সীমারেখা, তাই এখানেই এসে 'তোমার' জন্য মায়া জেগে উঠল সহসা। আর কথকের এই মায়াই স্পষ্ট করে তুলেছে তার 'তুমি'র মনের কথাটি যে ভালোবাসায় আশঙ্কায় স্পন্দিত। বাড়ি ছেড়ে যাওয়া মানুষের জন্য মৃত্যুচিন্তা যে বাড়িতে পড়ে থাকা আর-মানুষের হয়, সে-ধারণা আমাদের কমবেশি থাকার কথা। আর বাড়িছাড়া মানুষটি, গৃহটানে, বাড়ির মানুষের প্রতি মায়ার সূত্রে 'তাদের'>'তোমার' মনের কথা [ কথাটি ] টের পেতে থাকে। নদীতীর শুধু জনপদের ওপারে নয়, জীবনেরও পরপারে চলে যাওয়ার সীমা। ফেরিঘাট শুধু নয়, শ্মশানঘাটও নদীতীরে। নদীতীরে এসে কবিতাটি শেষ হল এভাবে: "গ্রাম পার হয়ে নদীতীরে/ বিদ্যুৎরেখায় দেখি/ শ্মশানকালীর জিভে তোমার মনের কথা/ লকলক করে।"
পুনরায় বলি, আমি যেভাবে পড়লাম, তা একান্ত আমার পাঠ, অন্য কেউ হয়তো অন্যভাবে পড়বেন, তার সুযোগ আলোচ্য কবিতায়, এবং বইয়ের অন্যান্য কবিতায়, ঘনিয়ে রয়েছে। আর তা যে আছে, সেটি জানতে গেলে, আমাদের একের পর এক পড়তে হবে 'সমীরের চটি'র কবিতাগুলি।
▪▪▪
Comments
Post a Comment