বিদুর।। বিষণ্ণ স্বাস্থ্যে সমুদ্রে যেও না : অনুরাধা বিশ্বাস।। পাঠ-প্রতিক্রিয়া : হিমালয় জানা
স্বল্পায়ু গাছের দেহভঙ্গিমা
অনুরাধা বিশ্বাস-এর বিষণ্ণ স্বাস্থ্যে সমুদ্রে যেও না (২০১৯) পড়তে পড়তে মনে হয় গ্রন্থনামের সতর্কবার্তাটি আসলে কপট এক আমন্ত্রণ। কারণ, এই বইয়ের ভাষা—অনুরাধার পূর্ববর্তী বই পুষ্পতাড়িত কোনো গন্ধের মতো-য় যার সূচনা এবং এই বইয়ে যার পরিণতিপ্রবণ এক রূপ আমি দেখতে পাচ্ছি—সমুদ্রের মতোই: উপমার পর উপমা, বিশেষণের পর বিশেষণ, অবিরাম ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরস্পরের ওপর। অসংকোচ প্রাচুর্যের এই ভাষা নিজের কলকব্জাগুলো লুকিয়ে রাখে না, বরং কবিতাপ্রক্রিয়ার আদিপ্রকরণগুলিকে মুক্ত করে দেয় এক স্বতশ্চল স্বপ্নপরিসরে। বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত: ‘অরণ্য গোধূলি’, ‘একটি পাহাড়ের মুখোমুখি’, এবং ‘সমুদ্রে যেও না’; কোনো কবিতারই আলাদা নাম নেই। একটি কবিতার পরিসরের মধ্যে সম্পূর্ণ এবং স্মরণীয় স্থাপত্যের আভাস এই বইয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না তেমন; কিন্তু পাওয়া যাবে পরাক্রান্ত এক জলরাশি, তার সব ঘূর্ণি ও স্রোতসহ, যা কবির হাতের শাসনও মানছে না সব সময়। আমাদের ক্ষুদ্র, ম্লান, ভঙ্গুর জীবনের অনুষঙ্গমাখা প্রবল এক লিরিকস্রোত অনুরাধার ঈষৎ এবড়ো-খেবড়ো গদ্যপঙক্তির ভেতর দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে দূর দেশকালে, সেখান থেকে ফিরেও তাকাচ্ছে ছেড়ে আসা উপকূলের দিকে; একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বর্ণাবলেপনে অনেক অনপনেয় বিরোধের কাব্যিক মীমাংসা করতে চেয়েছে এই লেখাগুলি। সেই মীমাংসা কোনো বিরোধভঞ্জন নয়, বরং সীমারেখার আবছা হয়ে আসা। একটি বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিসরে আমূল প্রোথিত এই কবিতাগুলি অস্তিত্বের সংকট ও দোলাচলের পীড়ন থেকে নিষ্কৃতি খোঁজেনি, বরং অস্থির একটি অবস্থান থেকে বুঝে নিতে চেয়েছে সেই বিপরীতের প্রণোদনাকে। প্রতিটি লেখাতেই সাক্ষ্য রয়েছে সেই বোঝাপড়ার: বাস্তবের সঙ্গে অতিবাস্তবের, প্রাত্যহিকের সঙ্গে অভূতপূর্বের, অর্থের সঙ্গে প্রলাপের, দূরের সঙ্গে কাছের, রূপকথা সঙ্গে তিক্ত প্রাপ্তবয়সের। প্রথম পর্ব থেকে একটি কবিতা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করছি:
একটি ঘোরলাগা সন্ধ্যাতারার নীচে কমজোরি ও অস্থিরচিত্ত স্ট্রিটল্যাম্প,
বাঁহাতের ভাড়াবাড়িতে আমাদের ঘর। জঙ্গলের আলো পর্দা গলে এসে
পড়েছে ঘুমের ওপরে। জেগে উঠেছে ফসফরাসের মতো, আমদের
নিভৃত অন্ত্র, আলজিভ, খাদ্যনালী। এমনই এক রাক্ষসের কথা মিনিকে
বলেছিলাম, আনন্দে যার মৃত্যু হয়েছিল, দুঃখ-শোকে যে হয়ে পড়েছিল
কাঁটাফুলের মতো রঙিন ও দীর্ঘায়ু। পেটব্যথার রাতে ও রেজাল্টের দুপুরে
আমাদের মিনি তাকে স্মরণ করে, আমরা স্মরণ করি দারুণ খুশির দিনে
একটি কাঁটাফল আমরা ছুঁড়ে মেরেছিলাম বাছুরের লেজে, সাটিনরুমালের
মতো হাত থেকে পিছলে গিয়েছিল বাড়ি ফেরার ট্রেন। জঙ্গলের আলো ও
অন্ধকার সবুজে মিনিদের পুকুর, বুড়ো মৃগেলের অনমনা পায়চারি
গোলদেয়ালের পাঁচতলা বাড়ি রাক্ষসদের, আমাদের ভূতে পাওয়া অন্ত্র
আর যকৃতে নেচে ওঠে। জঙ্গলের মেঝেতে বরফ, পাতায় বরফ, ফুঁ দিতে
দিতে, ভোরবেলায় বাসি কাপড়ে ঝাড়ু দিতে দিতে তোমাকে বলি—
জ্যোৎস্নায় বরফশাসন করা একখানি নেকড়ে বাঘ আমার পছন্দের দুঃস্বপ্ন (পৃ ২০)
‘কমজোরি ও অস্থিরচিত্ত স্ট্রিটল্যাম্প’ ছোটো শহরের মধ্যবিত্ত পাড়ার একটি সান্ধ্য গলির ছবি জাগায় মনে। স্ট্রিটল্যাম্পটি হয়তো একটু খামখেয়ালি; ইচ্ছেমতো জ্বলে-নেভে, দপদপ করে। রাস্তা হারানো আর বাড়ি ফেরার অনুষঙ্গ ঘুরেফিরে আসে এই বইয়ের কবিতাগুলিতে; এখানেও যেমন: ‘সাটিন রুমালের/ মতো হাত থেকে পিছলে গিয়েছিল বাড়ি ফেরার ট্রেন।’ কমজোরি স্ট্রিটল্যাম্পের উল্লেখ, এই বইয়ের অর্থপ্রতিবেশে, জড়ো করে মধ্যবিত্ত জীবনের সব অসুস্থতা, ক্লিন্নতা, ক্ষয়, অবসাদ, আর উদ্বেগ—যার ওপরে ঘোর-লাগা সন্ধ্যাতারা জেগে থাকে এক সৌন্দর্যময় উদ্ভাসন হয়ে। ভাড়াবাড়ি, পেটব্যথার রাত, রেজাল্টের দুপুর: সবই সেই অনিবার্য শৈশবচিহ্ন। কিন্তু এই ছোটোবেলাকে ঘিরে আছে রূপকথার এক জঙ্গল। খুব দূরেও নয় সে। কারণ পর্দার ফাঁক দিয়েই সেই জঙ্গলের আলো এসে পড়ছে ঘুমের ওপরে। কিছু পরেই আছে ‘জঙ্গলের আলো ও/ অন্ধকার সবুজে মিনিদের পুকুর’। এই রাক্ষস কিন্তু নিতান্তই গৃহস্থ, ‘গোলদেয়ালের পাঁচতলা বাড়ি’ তাদের নিশ্চিত আবাস। শিশুকল্পনায় যেমন প্রতিদিনের তুচ্ছ সব খুঁটিনাটিই রূপান্তরিত হয় কল্পজগতের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞানে, এখানেও তেমনই ঘটছে। দু-বার কবিতাটি প্রবেশ করছে শরীরের অভ্যন্তরে—সেও এক না-দ্যাখা জগৎ আমাদের, কিন্তু ঘুমন্ত রাক্ষসের মতোই যার জেগে ওঠা টের পাই আমরা। ভূতে পাওয়া অন্ত্র আর যকৃত। কল্পনা, এমনকি কবিতার প্রক্রিয়াটিও এই সব লেখায় এক শারীরিক দ্যোতনা লাভ করে। বইয়ের প্রবেশকটি শুরু হচ্ছে এই ভাবে: ‘বড়ো বেশি তিক্ত হয়ে উঠেছে লালা, ওগো ঢালু জমির সিমেন্ট বাঁধানো দেবতা,/ একখানা উপায় দেখাও। মিষ্টি ফলের শাঁস ভরে দাও আমাদেরর দুঃখের গানে’। অন্ত্র, যকৃত, আলজিভ আর খাদ্যনালীর ভেতর থেকেই যেন উঠে আসছে এই চেতনাস্রোত, অভাবিত পারম্পর্যে যা বয়ে আনছে সময়ছিন্ন সব ছবি। এই কবিতাটির আড়াই-পঙক্তিব্যাপী শেষ বাক্যটি যেমন অনায়াস অবহেলায় জুড়ে দিচ্ছে বরফশাসন করা একটি নেকড়ে বাঘের সুদূরতার সঙ্গে ভোরবেলায় বাসি কাপড়ে ঝাড়ু দেওয়ার ঘনিষ্ঠতা। সব দৃশ্য এবং অদৃশ্য, সুদূর এবং নিকট—আমাদের জীবন যাদের অনিবার্য ছায়াপাতে বাঙ্ময়—এই কবিতাপর্যায়ে এক প্রবহমান অন্তর্বয়নে বিন্যস্ত। ‘এমনই এক রাক্ষসের কথা মিনিকে/ বলেছিলাম, আনন্দে যার মৃত্যু হয়েছিল, দুঃখ-শোকে যে হয়ে পড়েছিল/ কাঁটাফুলের মতো রঙিন ও দীর্ঘায়ু। এই সব কবিতা তাহলে বড়ো হয়ে ওঠারও গল্প: যে-রাক্ষসকে নিজের বাইরের এক রোমাঞ্চকর আতঙ্ক ব’লে মনে হয়েছিল, তাকেই নিজের শরীরে ও সত্তায় টের পাওয়ার মতো বিষণ্ণ আবিষ্কার।
‘আনন্দ’ শব্দটি এই বইয়ের কবিতাগুলিতে ফিরে ফিরে এসেছে। কখনো বা তাকে নাম ধ’রে ডাকা হচ্ছে, তাকে উদ্দেশ্য করেই রচিত হচ্ছে কবিতাটি। সব সংশয়, দ্বিধা, মালিন্য, অসহায়তাকে এই কবিতাগুলি ঠেলে দিতে চেয়েছে সেই আনন্দের দিকে। তবু এই কবিতাপৃথিবী এক শীতোন্মুখ হেমন্ত ঋতুর, হলুদ রঙের। ষোলো পৃষ্ঠার কবিতাটি শুরু হচ্ছে: ‘আনন্দ, এত হলুদ আর বিস্ময়ের মাঝেও বেঁচে থাকার জন্য বড়ো/ পরিশ্রম। বেঁচে থাকার ইচ্ছের জন্য কত সুদীর্ঘ ও সুদৃশ্য খাদ হতে,/ কালো ও জটিল তরঙ্গ হতে আমি মুখ ঘোরালাম।’ পরের কবিতাটির শেষ: ‘অন্নের সুগন্ধ এল এমন সময়ে—/ শীতবস্ত্র হতে গলা বের করে আমরা দেখলাম এই সাদা শূন্য দেশ,/ বৃদ্ধের কন্ঠমণির মতো কাতর ও বিষণ্ণ পাহাড়।’ লক্ষণীয় ‘হতে’ শব্দটির ঈষৎ কাব্যিক প্রাচীনতা, যা এই পঙক্তিগুলিকে দিচ্ছে আসন্ন ঊষরতার সামনে জীবনের জন্য এক চিরন্তন প্রার্থনার সুর। ‘আনন্দ’ এই কবিতাগুলির কেন্দ্রে এক অনুপস্থিতি: অভাব এবং সম্ভাবনার। ‘আনন্দকে এতকিছু লিখব—কিন্তু সেও কি আছে কোথাও?/ তাকে লিখব আরও অধিক, তার থাকার সম্ভাবনায় ওই পক্ষীশাবকের কর্কশ কন্ঠে/ আমাদের ভোর হল।’ (পৃ ১৪) প্রথম পর্বেরই আর একটি কবিতা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করি:
বিস্ময়ে তৈরি হল অনন্ত। একটি স্বল্পায়ু গাছের দেহভঙ্গিমা দেখে
স্থির হলাম আমাদের দৃষ্টিবিনিময়ের ভিতর বদলে গেছে দীর্ঘ নদীদের
পথ, বিলুপ্ত হয়েছে একশত প্রজাতির পাখি। কখানা চেনা প্রকৃতির গাছ
আর চেনা রঙের আকাশ ছিল বলে ভিনদেশে আমরা টিকে গেছি।
অন্যমানুষের জামা, অন্যমানুষের কোট পরে পা উঁচু করে হেঁটে
বড়ো হয়েছি একসময়ে। অন্য কারো কলম ধার করে এসে বসেছি হ্রদের ধারে।
এই বিকেল বুঝি আগেও ছিল, আমি ছিলাম বিকেলেরও আগে;
কেবল আজই, একটি অনাত্মীয় গাছের ভিতর দৃষ্টি ও পথ হারিয়ে ফেলে
আমাদের সাক্ষাত হল। দুহাজার মাছ বদলে ফেলল রং, কচ্ছপরা ডুবে
গেল ভাবুক পাথরের মতন। মানুষের মাথা বড়ো হল, অতিক্ষুদ্র করপুটে
ধরা রইল কটা টিকিট আর পুরোনো পয়সা
(পৃ ২৬)
শৈশবের ফুরিয়ে আসার সঙ্গে এই কবিতায় সমাপতিত হচ্ছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার অনুষঙ্গ। শৈশব এখানে আর একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়ে নেই, বয়সের হিসেবেই তাকে বোঝা যাবে না শুধু। শৈশব আসলে এক অপ্রবাস, যেখানে নিজের সঙ্গে জগতের, নিজের সঙ্গে নিজের কোনো বৈরিতা নেই, বিচ্ছেদ নেই। ‘ভিনদেশে আমরা টিকে গেছি’: এই ভিনদেশ হতে পারে সত্যিকারের বিদেশ, অথবা ভাস্কর চক্রবর্তী যে-বিদেশের কথা লিখেছিলেন: ‘বাস থেকে নেমে মনে হলো/ বিদেশেই আছি।’ শৈশবেও ছিল এক অন্য বিদেশ, এক অব্যবহিত রোমাঞ্চ। কিন্তু তারপর ‘দুহাজার মাছ বদলে ফেলল রং, কচ্ছপরা ডুবে/ গেল ভাবুক পাথরের মতন।’ কবিতা লেখার পেছনেও কি নেই ভাষার সঙ্গে এক বিচ্ছেদের বোধ? শ্বাস নেওয়ার অনায়াস সাচ্ছন্দ্য বিঘ্নিত হলেই একমাত্র শ্বাসক্রিয়াটির সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়ি আমরা। কবিতা লেখার সঙ্গেও আছে ভাষার অপ্রতুলতার যোগ। আমাদের চেনা জগৎ যখন ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যায়, আমার অভিজ্ঞতা যখন পরিচিত ভাষার সীমা উপচে পড়ে যায়, তখনই আমাদের ভাষার সন্ধানে বেরোতে হয়। সেও এক বিপদসঙ্কুল যাত্রা। কারণ সেখানে আছে পদে পদে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়, আর শেষ অবধি এই উপলব্ধির সামনে দাঁড়ানো যে আমার ভাষা শুধু আমারই নয়, ঠিক যেমন এই বিকেলও নয় শুদ্ধ, অকৃত্রিম কোনো অভিজ্ঞতা। কত দূরের এই উপলব্ধি আমাদের শৈশব থেকে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল প্রথম এবং অবিকল্প। ‘এই বিকেল বুঝি আগেও ছিল, আমি ছিলাম বিকেলেরও আগে’। বিকেলেরও আগে সেই অখণ্ডতার জন্য একটি স্মৃতিকাতর আকাঙ্ক্ষা এই সব কবিতার আপাত-অসংলগ্ন, অনুষঙ্গনির্ভর চিত্রকল্পের অস্থির বিন্যাসের ভেতরে ক্রিয়াশীল। এই লেখার শেষ চিত্রকল্পটিতে আমি খুঁজে পাই চৈতন্যপীড়িত এক মানুষের আকাঙক্ষা—বস্তুর নিরুদ্বিগ্ন, স্পর্শযোগ্য অপাপবিদ্ধতায় ফিরে যাওয়ার। ‘কেবল আজই, একটি অনাত্মীয় গাছের ভিতর দৃষ্টি ও পথ হারিয়ে ফেলে/ আমাদের সাক্ষাত হল’। অনাত্মীয় শব্দটিতে থেমে থাকা যায় কিছুক্ষণ: কবিতা, উৎসের অখণ্ডতায় ফেরার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও, কখনই সেখানে ফিরিয়ে দিতে পারে না আমাদের, তা আমাদের জন্য তৈরি করে দিতে পারে নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার বোধের মধ্যেই দুই দৃষ্টিহীন কিন্তু পথসন্ধানী মানুষের মিলিত হওয়ার ক্ষণপরিসর। একটি ‘স্বল্পায়ু’ গাছ।
Comments
Post a Comment