বিদুর ব্লগজিন : পঙ্কজ চক্রবর্তী-র কবিতা


কবি পরিচিত।। 
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির পর কবির প্রথম কবিতার বই 'বিষণ্ন দূরের মাঠ ' প্রকাশিত হয় 'সর্বনাম' প্রকাশনা থেকে ;সময়, ডিসেম্বর ২০১৭। উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্যামনগরের বাসিন্দা পঙ্কজ চক্রবর্তী সম্পাদনা করেন 'সর্বনাম' নামে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। ২০১৯ -এ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই 'চার ফর্মার সামান্য জীবন ( নাটমন্দির ২০১৮) এবং শেষ কবিতার বই 'উদাসীন পাঠকের ঘর '(তবুও প্রয়াস)। রয়েছে তাঁর একটি গদ্যের বই 'নিজের ছায়ার দিকে '(ইতিকথা, ২০২০)। 


পঙ্কজ চক্রবর্তী -র গুচ্ছ কবিতা 

মাধবীলতা

মানুষের পাশে ঘুরে শোকসমিতির প্রতি তুচ্ছতা এসেছে। এসেছে মাধবীলতা আশ্চর্য সহজ। তুমি অস্বচ্ছ নগরীর শেষ কোলাহল। যে-পথে গৃহবন্দী মানুষ দু-রাত স্বপ্নে জেগে থাকে। মেয়ের স্তনের দিকে অপরাধী পাশ ফিরে শোয় প্রাগৈতিহাসিক পিতা। উৎসবে হরিণের ছাল। বল্কলে লতায় পাতায় মেঘাচ্ছন্ন শেষ হাতিয়ার, উন্মত্ত এই কেশভার। তবু তো সহজ এসেছে-ভাষায় ভিতরে অকাতরে ঘুমোয় ওই লোভী ক্রিয়াপদ। পরাজিত মানুষ উচ্ছিষ্ট তুলে রাখে  আর ভাবে সন্ধ‍্যাপ্রদীপের আলোয় গুনে নেবে স্বর্ণমুদ্রা--- সহস্রবৎসর বসে খাবে। তবু এই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দেশে ওহে জীবন তুমি নিমপাতার হাওয়ায় বিশুদ্ধ সর্বনাশ তুলে রাখো। মৃতদেহের পাশে বসে মনে হয় সর্বদেহে বানিজ‍্যের কমলেকামিনী। ভয় পাই। পুনশ্চ সুখ এসে অনিবার্য ছায়া ফেলে ভাতের থালায়। মনে হয় যৌনপরাজয় উবে যাবে কর্পূরের মতো। একটি সোনার নথ পরিযায়ী কবচকুন্ডল। প্রতিশব্দ শিশিরে ঘাসের কুয়াশায় ঢেকে রাখে সাপের খোলস।
দিন যায়। দিন যে বৃথাই যায় অস্বচ্ছ নগরীর কুমারী নদীটির মতো। উৎপাদক ফুল তোমার মহিমা খেলার ছলে  ভেঙে দিয়েছি যখন অবিন‍্যস্ত চুলে দাও অশেষ চুম্বন।



ন্যাপথলিনের শোক

এসো এই অপরিমিত শস‍্যের গায়ে হাত বোলাও। যতক্ষণ রূপকথা দন্ডিত মানুষের আয়ুরেখা আঁকে।সূর্যাস্তে উড়ছে সব ধুলোমাখা স্মৃতি। মৃত মেয়ের কথা  মনে পড়ছে যখন ওর মতো বিড়বিড় করে জুড়ে দাও অহেতুক অপাপবিদ্ধ খেলা। দন্ডিত সবুজের দেশে কুসুমের রং। গর্ভকেশর। সেইদিনের রাজার গল্পটা বলো। যার শরীর জুড়ে পলাতক মানুষের চোখ।।প্রহরীর মৃত‍্যুদণ্ড। তারপর মনে পড়ুক ঘুমের ভিতর কীভাবে বদলে গেছে পথ।সেই পথে ধীবরের জাল খেলা করে। মনে মনে  একটি প্রকান্ড বাঘ সাক্ষী রইল তোমার রূপের। আর এক পেপে গাছের  মলিন স্তনভার।বুকজোড়া দুধের পিপাসা। তারপর নীরবতা জলের সমান। 
এখন সবুজ তিথি। বংশানুক্রমিক ঐ ব‍্যক্তিগত অভিমান --- পাঁচিলের দুষ্প্রাপ্য বই।
মৃত মেয়ের ছবির চেয়ে  সুদর্শন পাখিসমাচার। গণআদালতে  ছুটির মহড়া । একচিলতে রোদ্দুরের গায়ে এই মৃত বনপথ।


পাঠশালা

জঙ্গলের ফাঁকে জেগে আছে মুগ্ধ পাঠশালা---  নামতাচরিত। আমাদের ভিজে কাঁথাখানি জড়িয়ে রয়েছে। পেন্সিলের ধারালো ফলায় রচিত হল দিনাবসানের চৈত্র মাস। পাতায় পল্লবে যেন বালকের মুগ্ধ সমাচার। একটি চড়াই খুঁটে খায় প্রশ্নপত্র--- মালিকের ছদ্মবেশী চোখ। আজ এতদিন পর হলুদ বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখি বারান্দায় এককোণে হাওয়ায় দুলছে, এলোমেলো, প্রাচীন চেয়ার। ছাত্র নেই। শুধু এক দপ্তরী নতুন মাস্টারমশাইয়ের সাথে গল্প জুড়েছে অবেলায়। ছায়ার দরোজা। সীমানা ভেঙে ঢুকে পড়েছে পার্টিঅফিস। হেডমাস্টারের ভাঙা দেরাজে লুকিয়ে রাখা আছে কম দামি মদ,পেটো,দড়ি ও পিস্তল। শুকনো নেশার দানাপানি।সংকেত আসে। মুদিদোকানের রহস্য ফুটেছে যেন ভোরের আকাশে।
হে প্রাচীন দৃশ‍্যপট, শতাব্দীপ্রিয়তা, আমাদের ঘামে ও রোদ্দুরে মিশে এই পথ চলে গেছে জংশন স্টেশনে। ছায়ার কঙ্কাল লেখে পুথিপাঠ, গবাদি পশুর দিকে ছুটে যায় আজও। সরকারি টাকা এসে ফিরে যায়। ধুলোবালির দেশে এই কাজ ,শূন‍্যের ঘরবাড়ি ,তুমি এক জোৎস্নাসাধিকা।


দুপুর

এই সন্তর্পণ দুপুরে ভাবি তোমার গৌরবের কাছাকাছি বসে থাকি। গোসাপের তাড়া খেয়ে উঠোনে এসে দেখি রোগা মানুষের ছায়া পৌঁছে গেছে অলীক রান্নাঘরে। পৃথিবী জুড়ে মানুষের কত কাজ। পিঁপড়ের নির্ঘুম রাতের মতো দুঃখবোধ। আমি তো এখনো জেগে আছি পারদর্শী মেঘের জানালায়। প্রতিটি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু গোয়ালাপাড়ার ঘোষেদের মেজছেলে বেরিয়ে পড়েছে সাইকেল নিয়ে। নাইট ডিউটি। তার ঘুম আমার চেয়েও বাঁকা পথে হাঁটে। ভোরের জলে তুমি ধুয়ে নেবে অনিচ্ছুক ঘুমভাঙা স্তন। আমি এই অপরূপ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ যেকোনো পন্থায় পথে নামব প্রাতভ্রমণে।
এইসব কথার ভিতরে কাহিনির বীজ দেখে লোকালয় বসে থাকে অন্ধগলিতে।তারপর মুদিদোকানের ছায়ায় ভুল বানানে ফর্দ লেখে। ভুল বানানে থানার বড়বাবুর হাতে তুলে দেয় বিচারের ভার। রাতের অন্ধকারে পাহারায় থাকে। টর্চ, মোমবাতি, চায়ের সসপ্যান জড়ো হয় ক্লাবের ভিতরে। মেদহীন মানুষের প্রতিরাতে এই বিবেচনা।
একটি সন্তর্পণ দুপুরে গানের হলুদখাতা কতদূর লজ্জাহীন ভাবো!



রক্তের ভিতরে

বাঘিনী চলেছে লোকালয়ে। জীবনের ধুকপুক সঞ্চারমান--- পরিত্যক্ত পল্লবের নিষিক্ত আভায় রক্তের ছায়া, যেন হত‍্যাদৃশ‍্য নিছক দর্শকহীন---নেই কোন প্রত‍্যাশিত চোখের তারিফ। এমনই অবেলায়, যখন ব‍্যস্ত শিকারে, ধীবরের গর্ভবতী বউয়ের বিষণ্ণ চোখের পাহারায়--- বাঘিনী  খুলে দেয় বেড়ালের হাসি। মনে মনে ভাত বেড়ে দেয় উদোম প্রান্তরে।মাঝরাতে কোনো কোনো বনকর্মী টের পায় চোখের জলের চরাচর।
গ্রামসেবকের দল জানাল পালাবার আগে শান্ত ছিল নখের ব‍্যবহার। সতর্ক জানালার পাশে এমন সুদূর অপেক্ষা  দেখে হতবাক মহিলার দল। ভাঙা শাঁখা পলার এক অলীক সরোবরে পরদিন পাওয়া গেল দেহ। পলাতক মেঘের সন্দেহ। লতাপাতায় ঢাকা মানুষের মুগ্ধ চোখ ,জলের অতল যৌনস্মৃতি। রক্তের ভিতরে লুকিয়ে আছে বিষণ্ণ জানালার অশ্রুমতী চোখ।
বাঘিনী চলেছে। সূর্যাস্তে নদীর জল, পড়ে রইল পাখির সংসার--- যে ফুল মানুষ দেখেনি কোনোদিন।

Comments