বিদুর ব্লগজিন : কুন্তল মুখোপাধ্যায়


কবি পরিচিত।। কুুুন্তল মুখোপাধ্যায় বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনেও সমান স্বচ্ছন্দ এবং লিখতে আসার পর, প্রথম বইয়ের জন্য পাঠককে প্রতীক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল ---

১। দুখীরামের গোপন জার্নাল (সিগনেট ২০১৬)
২। অন্য এক অন্ধকার (তবুও প্রয়াস ২০১৮)
৩। নির্জনতা, এগারো মাইল ( ভাষালিপি ২০১৯)

কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত পত্রিকা মথ। বীরভূমের সিউড়িতে তিনি বসবাস করেন। 



কুন্তল মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা 


শরণার্থী 

বিনিদ্র বলেই হয়ত অন্য কারো স্বপ্নে আসো তুমি । বিনিদ্র বলেই হয়ত অঘোরে ঘুমের ভিতরে ডুবে যাওয়া কাউকে ঈর্ষা করো, কারণ আমি ঘুমাই আর আমার মতো ছোটো বড়ো শৈবালের হাত দেখা হয় না তোমার। তুমি তাই বলো, যারা ঘুমাতে পারে, তারা মাথামোটা হয়। সংবেদী মানুষের নাকি ঘুম হতে পারে না কখনও। 

কী প্রমাণ করতে চাও? যারা আমার স্বপ্নে রোজ ভিড় করে, তারা কি আমার মতো বুদ্ধিহীন নয়? তাহলে যে যুবকটিকে আমি স্বপ্নে দেখেছি রেললাইনের উপরে একটা কাটা হাত ধরে আছে, বাজাচ্ছে হারমোনিয়ম, বাতাসে বেলো করছে , তারও শয্যার পাশে হাসছে অমোঘ ঘুমের বড়ি?

তাহলে এই যে আমি দেখলাম, অজস্র বামন জোরে জাতীয় সংগীত গায় আর হস্তমৈথুন করে, এই যে আমি দেখলাম একজন একখানা কাটা স্তন নিয়ে লুফতে লুফতে চলে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে, এই যে দেখলাম এক কন্ডাক্টার তার ব্যাগ থেকে রেজকি গোনার মতো গুনছে আর বের করছে এক মাস দু মাসের শিশুর মাথা 

মেফিস্টোফেলিস, তুমি বলো এরা কি রাত্রিবেলা ঘুমাতে পারে না কেউ? আর তাই হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়ে আমার স্বপ্নের মধ্যে?


ক্ষণ 

সারা পৃথিবী ঘুরে এই যে তুমি আবার ফিরে এলে আমার চৌকাঠে, তুমি বললে এবার তোমার সরণ শূন্য হল আর আমি বুঝলাম পৃথিবী গোল। পরাজিত মানুষের ভাঙা ভাঙা মুখ আর তার দৃষ্টি কাঁধে নিয়ে এইবার আমাকে চলে যেতে হবে নিজস্ব দিগন্তের দিকে, যেখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ফেরেব্বাজ, টাউট আর বেঁটে মানুষরা। তুমি বললে এর মাঝখানে কোথাও অনন্ত নেই।

পরিবর্তে আমার চলার পথে তোমার নষ্ট করা মাইলফলকের সঙ্গে দেখা হয়, পরাজিত তারাও, ট্রামগাড়ির প্রায়ান্ধকারে নিজেদের বিষাদ বলে, আমি তাকে ছুঁয়ে থাকি, ভাবি এখানে কি অনন্ত আছে?

মুদ্রকের কষ্টের জীবনে চাঁদ এনে দেবে কেউ? স্বপ্নের ভিতরে আমি বলি ওহে ত্রিকালদর্শী সিংহ এই বিষাদ কখনও কি ছুঁয়েছে তোমাকে? মেডিটারেনিয়ান ধরে সমালোচকেরা জাহাজ ধরে চলে পূর্ব ইয়োরোপের দিকে... যেখানে অসংখ্য পাখি উড়ে যাচ্ছে শরণাগত 

যেখানে অনন্ত নেই...


গন্তব্য 

প্রতিটি ধর্মের মধ্যে আছে শান্ত প্রশ্রয় আর স্তব্ধতা যেখানে লুকিয়ে থাকে সন্ত্রাস, প্রতিটি সৃষ্টির জগতে আছে ঈর্ষা, ভালোবাসাবাসি থেকে দূর এক রাক্ষসীর রাজপ্রাসাদ 

প্রতিটি ঘরের মধ্যে স্বার্থের গহন অন্ধকার। আর অন্ধকারে পথ পেতে তুমি একটা বই খুলে আলো দেখতে দেখতে পথ হাঁটো। এক একটা বাড়ি যেন ওলা ক্যাবের মতো দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে।

জানলা দিয়ে চালককে যদি বলো কোথায় যাবেন? সে বলে জানি না ভাই... কে কোথায় কখন আমাকে ডেকে নেয় ...


এন্ড্রোয়েড 

যেকোনও দৃশ্যকে দু-আঙুলে টেনে জুম করে দেখতে পাই অন্ধকার অথবা ঝাপসা অসংখ্য বিন্দু।আমি তাই তোমাকে দেখলেই টেনে জুম করি, তুমি অজস্র পিক্সেলে ফেটে যাও। দুনিয়া এন্ড্রয়েড। এন্ড্রয়েড দুনিয়া। আমি তাই দু-আঙুল দিয়ে দুঃখ সরিয়ে দিই, বীভৎসতা, নির্জনতা সরিয়ে দিই, সরাতে সরাতে দেখি আমার সমস্ত পলায়ন তর্জনীসুন্দর । 
কবিতাই লিখব ভেবেছিলাম, এখন দু-আঙুল দিয়ে জুম করে দেখি আরও কিছু আকাঙ্ক্ষা ছিল গভীরে। পরিচিতি, খ্যাতি এইসব ঘন পিক্সেলের আঁধার দেখতে পাই আমি, তাই সরিয়ে সরিয়ে চলে যাই ভণ্ডামীর দিকে স্তুতির দিকে। সরাই মুগ্ধবোধ, সরাই বেদনা ।অন্যের সাফল্য দেখে আমার ঈর্ষা হয়, দু-আঙুলে সরাই, সরিয়ে দিই তাকে; এইভাবে, ক্রমশ আমার সৎ ও ঋজু তর্জনীতে ব্যথা অনুভব করি, আঙুল তুলতে ভয় পাই। এই এন্ড্রয়েড জীবন আমায় শুধু শিখিয়েছে আপোষ, ঈর্ষা নামে শুক্রগ্রহ থেকে বন্ধুরা আমাকে ডাকে, আমি এন্ড্রয়েড জীবন নিয়ে হেঁটে বেড়াই। তর্জনী অসার, বাঁকা।



বহিরাগত 

ফ্ল্যামিংগো পাখির রক্তরঙা দুধ খেয়ে তার বাচ্চা বড়ো হয়। আর বাচ্চার লম্বা গলার রঙ বদলাতে থাকে। ফ্ল্যামিংগো পাখিরা জমা হ্রদের নিম্ন তাপমাত্রা থেকে বহুপথ উড়ে এসে টলমলে জলে ভেসে থাকে। এই টলমলে জল সে তার গায়ে জড়িয়ে নেয়। ফ্ল্যামিংগো পাখিরা উচ্চতা চেনে আর তাই এমন উচ্চতায় সে উড়ে বেড়ায় যেখানে ঈগল আসতে পারে না। 

ফ্ল্যামিংগো, আমার ভাই। এসো আমরা গলা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকি অনন্তকাল। ফ্ল্যামিংগো আমার ভাই একদিন স্বপ্নে দেখেছি আমার মুখের থেকে বেড়িয়ে আসছ তুমি। ফ্ল্যামিংগো আমার ভাই একদিন গান গাইব রাত্রিবেলা উড়ে যেতে যেতে। সন্ধাতারা দেখতে দেখতে কালপুরুষ দেখতে দেখতে আমরা উড়ে যাবো। 

কালপুরুষ। 
পৃথিবীর আকাশ থেকে দূরে , ঈগলের দৃষ্টির অনেক উপরে।












Comments