বিদুর ব্লগজিন : বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর নির্বাচিত বারোটি কবিতা।



তিন পাহাড়ের স্বপ্ন
কাব্যগ্রন্থ : তিন পাহাড়ের স্বপ্ন

এত গান আকাশে
এত গান বাতাসে!
                  
                 সাঁওতাল মেয়েটির টিপ কপালে
                 ছেলেটি পেছন তবু নিলো কী-ব'লে?
                 রাঙাফুল মেয়েটির খোঁপায় জ্বলে
                ছেলেটি বাজালো বাঁশি তবু কী-ব'লে?

এত মদ আকাশে
এত মদ বাতাসে!

                নেশা যেন ধরে যায় ছেলেটির বাঁশিতে
              মনে হয় দোষ নেই ভালোবাসা-বাসিতে,
               তবে চাঁদ সরে যাও, যাও তা হলে ...
            ' ও ছেলে, পেছন তুই নিলি কী- বলে?'

         'পথ ভুলে গেছি মেয়ে খিলখিল হাসিতে;
       শোন্, কোনো দোষ নেই ভালোবাসা-বাসিতে।' 

এত আলো আকাশে
এত আলো বাতাসে! 


রুটি দাও
কাব্যগ্রন্থ : উলুখড়ের কবিতা

হোক পোড়া বাসি ভেজাল মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে বহ্নি নেবানো খাঁটি
এ এক মন্ত্র! রুটি দাও, রুটি দাও, 
বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও :
সমরখন্দ বা বোখারা তুচ্ছ কথা
হেসে দিতে পারি স্বদেশেরও স্বাধীনতা।

শুধু দুইবেলা দু'টুকরো পোড়া রুটি
পাই যদি তার সূর্যেরও আগে উঠি,
ঝোড়ো সাগরের ঝুঁটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া :
হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি। 


ভিসা অফিসের সামনে
কাব্যগ্রন্থ : জাতক

দুই মানুষ দুই পথে চলে গেল ;
যতক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় 
ওরা অপেক্ষা করছিল।

একজন অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিলো,
আসি!
আরেকজন অনুভব করেছিলো সৎভাইয়ের যন্ত্রণা।

দুটি কঠিন পাথরের মুখ 
খোদাই করা
নিষ্প্রাণ দুই জোড়া ঘোলাটে চোখ
অদৃশ্য রক্তের তোলপাড়ে একই অধিকারে মৃত পিতাকে স্মরণ করছিলো।

আর এখন, এমন দিনে
যদি সে-মুখ আবার মনে পড়ে, রক্তে বাজে না-দেখার কঠিন ব্যর্থতা
তখন কোথায়, কোন রাস্তায় এসে দাঁড়াবে
দুটি সৎভাই? সমস্ত আকাশটাই যেখানে দেয়াল দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা।


আশ্চর্য ভাতের গন্ধ
কাব্যগ্রন্থ : মুখে যদি রক্ত ওঠে

আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির-আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।

আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়, সারারাত।

অন্নদেবতা
কাব্যগ্রন্থ : মুখে যদি রক্ত ওঠে

"অন্নমিতি হোবাচ সর্বাণি হবা ইমাণি ভূতান্নমেব
প্রতিহর—মাণামি জীবন্ত সৈষা দেবতা..."
                                       ছান্দোগ্যোপনিষদ

অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।।

অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার।
সে অন্ন যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।।


ভুবনেশ্বরী যখন
কাব্যগ্রন্থ : ভিসা অফিসের সামনে

ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে
একে একে তার রূপের অলঙ্কার
খুলে ফেলে, আর গভীর রাত্রি নামে
তিন ভুবনকে ঢেকে;
সে সময়ে আমি একলা দাঁড়িয়ে জলে
দেখি ভেসে যায় সৌরজগৎ, যায়
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল নিরুদ্দেশে
দেখি আর ঘুম পায়।। 



মহাদেবার দুয়ার
কাব্যগ্রন্থ : মহাদেবের দুয়ার

১২
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে 
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ'রে 
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল ফল ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে
                      পাখিদের ক্ষুধা মেটে ;
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে 
যদি আমি মাটিকে জানতাম!



জন্মভূমি আজ
কাব্যগ্রন্থ : মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে


একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে

এখনো রাত শেষ হয় নি ;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
মাথার ওপর একটা ভয়ংকর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ংকরকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।

মাটি তো আগুনের মতো হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।



মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে
কাব্যগ্রন্থ : মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে

'The earth is filled with mercy of God '

অসীম করুণা তার, ঐ বধ্যমঞ্চ, যাকে বলি মাতৃভূমি ;
জল্লাদেরা প্রেম বিলায় কোলের শিশুকে, তাঁর লীলা!
কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের ভিতর রক্তপাত—

মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, 'রঙ্গিলা! রঙ্গিলা!
কী খেলা খেলিস তুই!'
যন্ত্রণায় বসুমতী ধনুকের মত বেঁকে যায়—
বাজারে মহান নেতা ফেরি করে কার্ল মার্কস লেলিন স্টালিন গান্ধী
                                  এক এক পয়সায় ...



রাজা আসে যায়
কাব্যগ্রন্থ : বেঁচে থাকার কবিতা

রাজা আসে যায়            রাজা বদলায়
নীল জামা গায়             লাল জামা গায়
এই রাজা আসে             ওই রাজা যায় 
জামা কাপড়ের              রং বদলায় ...
                                    দিন বদলায় না।
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে!
পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনো জ্বলবে!


রাজা আসে যায়            আসে আর যায়
শুধু পোশাকের                রং বদলায় 
শুধু মুখোশের                 ঢং বদলায়—
             পাগলা মেহের আলি 
              দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায়, ওই রাস্তায়
                 এই নাচে, ওই গান গায় :
'সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়।'


জননী জন্মভূমি
সব দেখে        সব শুনেও অন্ধ তুমি! 
সব জেনে        সব বুঝেও বধির তুমি! 
                     তোমার ন্যাংটো ছেলেটা 
             কবে যে হয়েছে মেহের আলি 
কুকুরের ভাত কেড়ে খায়
              দেয় কুকুরকে হাত তালি—

তুমি বদলাও না;
সে-ও বদলায় না।

শুধু পোশাকের রং বদলায়
শুধু পোশাকের ঢং বদলায় ...



পৃথিবী ঘুরছে
কাব্যগ্রন্থ : পৃথিবী ঘুরছে

'E pur is muove ' Galileo

চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিলেন, 'পৃথিবী ঘুরছে না। '
পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবে ;

যতই তাকে চোখ রাঙাও না।



রাম কিঙ্কর
কাব্যগ্রন্থ : সত্তর আসির কবিতা

মাটি আসল
তারপর এক চিলতে আকাশ

সমস্ত ঘর এক মায়াবী নির্জনতা 
সেখানে যখন জ্যোৎস্নার চাঁদ উঁকি মারে
মনে হয় মানুষ কথা বলছে

তার মাথার ওপর
একটা আগুনের হারিকেন লণ্ঠন 
এক সময় অস্থির হয়ে ওঠে

চাঁদের সঙ্গে সে কথা বলে
'মাটি চাই, আরও মাটি ...'

নিজের গড়া মূর্তি 
সে তখন নিজের হাতে ভেঙে ফেলে।

কখন রাত গড়িয়ে দুপুর আসে 
তখন সে ঘর ছেড়ে মাঠে 

তার মনে থাকে না
মাথার ওপর, মাথার ভিতরে
একটা ক্রুদ্ধ সূর্য গর্জন করছে ;
মনে থাকে না,

সে ক্ষুধার্ত! মদ ছাড়া কিছুই তার পেটে পড়ে নি...

।।ঋণ স্বীকার।। 
দেবজ্যোতি রায়।। চাকদহ, নদিয়া।। 

Comments