বিদুর ব্লগজিন : শতবর্ষে বীরেন্দ্র স্মরণ।। গৌতম বসু
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় জরুরী অবস্থার অভিঘাত
গৌতম বসু
১৯৭৫ সালের ২৫-এ জুনের রাত্রে, ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত জরুরী অবস্থার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং তার কয়েক ঘণ্টা পরে,স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গান্ধী বেতারে দেশবাসীকে তা জানিয়ে দেন। আমরা যে তমসাচ্ছন্ন সময়ের কথা বলছি, সেটা আজকের অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বিচিত্র অনুভূতি হয় বই কি, কারণ, স্পষ্টই, আইন-ব্যবস্থাকে তখন দেশে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হত। ১৯৭৫-এর প্রতিতুলনায়, আরও বেশ কয়েক ধাপ আমরা নেমে এসেছি; দেশের আইন-ব্যবস্থা, প্রশাসন-ব্যবস্থার কাছে তার পূর্বার্জিত উচ্চতম স্থান, আজ খুইয়ে বসেছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় জন্মভূমির অনেক দুঃসময়, চরিত্রে ও মাত্রায়, দেখেছেন, এ নিয়ে সংশয় নেই; তবু, একবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ তাঁকে যেতে হয় নি ব’লে আমাদের দৃষ্টিতে তিনি সৌভাগ্যবান। তাঁর যুগের প্রেক্ষিতে, বিশ্বাসভঙ্গ ও বিশ্বাস-অর্জনের চিত্রটি ছিল যুগপৎ ভয়ঙ্কর ও সুন্দর। এক দিকে যেমন শাসনযন্ত্রের একের-পর-এক অনাচার তাঁকে দেখে যেতে হয়েছে, ঠিক তেমনই, তার বিপরীতে, বিগত শতাব্দীর পাঁচের ও ছয়ের দশকের গণ-আন্দোলনগুলি তাঁর লেখনীকে যত দগ্ধ করেছে, ততটাই শুদ্ধ করেছে। জরুরী অবস্থা তাঁর বিশ্বাসের জগতের উপর শেষ আঘাত। প্রায় একুশ মাস পর, ২১-এ মার্চ ১৯৭৭-এ, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার ক’রে নেওয়া হয়, কিন্তু তার মাস দুয়েক পূর্বেই, ১৮ই জানুয়ারী,১৯৭৭-এ প্রধানমন্ত্রী নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার ঘোষণা করেন এবং দফায়-দফায় রাজবন্দীদের মুক্ত করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাক্রম লক্ষ ক'রে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল ব’লে মনে হয়। নভেম্বর বিপ্লবের স্মরণে এবং জরুরী অবস্থা ঘোষণার কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশিত তাঁর এক ফর্মার কাব্যপুস্তিকায় [‘পৃথিবী ঘুরছে’(প্রথম প্রকাশ:৭ নভেম্বর ১৯৭৫)], যিনি অশান্তচিত্তে লিখেছিলেন,
এই জন্ম
কোন্ জন্মান্তর? এই কসাইখানায়
ভৌতিক সঙ্গীত? রাজপথে
নৃত্যের মুখোশে জ্বলে রক্ত ... কার রক্ত?
এই জন্মে কে তুমি? কোথায় যাও? পথ
যতদূর দেখা যায় নদী, শীর্ণ, লোহিত...
নরক কোথায় ছিল এতকাল? কেমন ঘুমন্ত,
এই শহরে! এখনো কবিতা লেখ?
তুমি কেন লেখ?
এ তো গান নয়, ছবি নয়
শুধু শ্মশান! এ-জন্মভূমি কবে ছিল তোমার?
তোমার জন্মের লগ্নে অহঙ্কার ছিল না? শুধুই
ক্রীতদাস–ক্রীতদাসী শিয়রে ... চারদিকে শূন্য
প্রান্তর, নিঃশব্দ, মৃত...
তুমি জন্ম নিয়েছিলে অনন্ত কান্নার মধ্যে
অনন্ত রক্তের মধ্যে ;
তবু স্পর্ধা, কবিতা লিখতে চাও! স্পর্ধা শুধু...
রচনাকাল : ৩ মার্চ ১৯৭৫
তিনিই, জীবনাবসানের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে, রোগজীর্ণ শরীরে, কিন্তু নির্লিপ্ত মনে, লিখছেন [কাব্যগ্রন্থ:‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ [প্রথম প্রকাশ(মরণোত্তর): ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫] :
এখন সন্ধ্যা নেমেছে
যাঁরা এলেন, তাঁদের আমি চিনি না
তাঁরা আমাকে স্পর্শ ক’রে বললেন,‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।’
যাঁদের চিনি তাঁরা কেউ আজ আসেন নি।
এখন আকাশে সন্ধ্যা নেমেছে, একটি দু’টি তারা
দেখা যাচ্ছে।
আমি প্রতীক্ষা করছি যে-কোনো চেনা-মুখের জন্য!
রচনাকাল : ১৭ জানুয়ারি ১৯৮৫
।। ২ ।।
আমরা সাধারণ ভাবে জানি, বিগত শতকের ছয়ের দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও নকশালবাড়ি-অভ্যুত্থান এবং, তার অব্যবহিত পরে সাতের দশকের ভারতের জরুরী অবস্থা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কবিত্বশক্তির সবটুকু নিঙড়ে বার ক’রে নিয়েছিল। মার্কিন আগ্রাসনের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণের সঙ্গে, ভারতের সনাতন বামপন্থী আন্দোলন থেকে ছিটকে বেরিয়ে-আসা সশস্ত্র সংগ্রামীদের সঙ্গে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কবিমনের গূঢ় সংযোগের প্রসঙ্গটি যতটা চর্চিত হয়েছে, তাঁর কবিতার উপর জরুরী অবস্থার অভিঘাত ততটা আলোচিত হয় নি। কবিতার সচেতন পাঠক অবহিত আছেন যে, জরুরী অবস্থা কবির সমস্ত অস্তিত্বকে বিপন্ন ক’রে তুলেছিল, কিন্তু তাঁর ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ঠিক কোথায় এবং কতদূর বিপর্যস্ত হয়েছিল তা যেন কালের নিয়মে কিছুটা বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের সঙ্গে সচেতন কবিতাপাঠকদের সংযোগ না-থাকায় কবির অন্তিম পর্বের সামাজিক প্রেক্ষিত কিছুটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে ব’লে মনে হয়।
জরুরী অবস্থার অনেকগুলি পূর্বসূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি সবই প্রধানত প্রণালীগত, প্রত্যক্ষ কারণটি ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার দুই অঙ্গ, প্রশাসনের সঙ্গে আইনব্যবস্থার সংঘাতে আমাদের খুঁজে নিতে হবে। ১৯৭১-র লোকসভা নির্বাচনে রায়বরেলী কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেন এবং পরাস্ত রাজ নারায়ণ বিজয়িনীর বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের একাধিক অভিযোগ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। মামলাটি নিজস্ব গতিতে গড়িয়ে –গড়িয়ে চলছিল, অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে। ১৯এ মার্চ ১৯৭৫-এ এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের বিচারপতি সিংহ প্রধানমন্ত্রী গান্ধীকে তাঁর বয়ানের জন্য আদালতে ডেকে পাঠান, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এর কয়েক মাস পরে, ১২ই জুন-এ রায় ঘোষিত হয়; ভোটদাতা-ক্রয় প্রভৃতি আর্থিক আনাচারের গুরুতর অভিযোগগুলি বাদ পড়লেও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার ক’রে বক্তৃতামঞ্চ নির্মাণ, বিদ্যুৎচুরি ইত্যাদি তুলনামূলক নিরীহ অভিযোগ যথাযথ প্রমাণিত হওয়ায় রায়বরেলী কেন্দ্রের নির্বাচনী ফল অবৈধ ঘোষিত হয় এবং শ্রীমতী গান্ধী তাঁর লোকসভার সদস্যপদ হারান, নতুন ক’রে তাঁর নির্বাচনপ্রার্থী হওয়াতেও ছয় বছরের জন্য নিষিদ্ধাজ্ঞা জারি হয়। শ্রীমতী গান্ধী নয়া দিল্লীতে অবস্থিত ভারতের উচ্চতম আদালতের দ্বারস্থ হন। ২৪-এ জুন,১৯৭৫-এ বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন, কিন্তু রায়ের কঠোরতা কিছুটা প্রশমিত ক’রে ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে শ্রীমতী গান্ধী-কে লোকসভায় উপস্থিত থাকার অনুমতি প্রদান করেন। নির্বাচনে দুর্নীতি তখনও এক পরিচিত বিষয় হলেও ভারতীয় রাজনীতিতে এটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন বৈশিষ্ট্য, কারণ স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পনেরো বছরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-র কার্যত কোনও প্রতিপক্ষ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কেবল দু’জনকে সমীহ ক’রে চলতেন, দক্ষিণপন্থী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং বামপন্থী ও বাগ্মী ভূপেশ গুপ্ত। ১৯৫৩ সালে কাশ্মীর পরিভ্রমণকালে শ্যামাপ্রসাদ-র রহস্যজনক মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রী নেহরু-র সমস্যার আট আনা সমাধান ক’রে দিয়েছিল,প’ড়ে ছিল বাকি আট আনা, ভূপেশ গুপ্ত। ভারতীয় ইতিহাসে ভূপেশ গুপ্ত-র আজ কোনও স্থান নেই; বোধকরি, জমিদারের পুত্রকে ফকিরের মতো জীবনযাপন করতে দেখলে আজকের মানুষ কেবল যে অস্বস্তি বোধ করেন তা নয়, হয়তো সন্দেহের চোখেও তাঁকে দেখেন। কিন্তু, এক সময়ে এই মানুষটি সারা দেশের বিবেকের পদটি অলঙ্কৃত করেছেন। আজও তাঁর বাকপটুতার বিবরণে রূপকথার ছোঁয়া লেগে আছে। একবার, ভূপেশ গুপ্ত ‘কুইন্স ইংলিস’-এ রাজ্যসভায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন, বিশেষণপদগুলি ফুলের পাপড়ির মতো ঝ’রে-ঝ’রে পড়ছে। উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার অধ্যক্ষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান দীর্ঘক্ষণ তাঁর ভাষণ শোনার পর নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলেন না, ভূপেশ গুপ্ত-র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ক’রে জানতে চাইলেন ওই অনবদ্য শব্দব্যবহার তিনি কোথায় এবং কীভাবে আয়ত্ত করেছেন। ভূপেশ গুপ্ত-র সংক্ষিপ্ত উত্তর,‘আপনার ছাত্র ছিলাম,স্যার।’
শুভ্র পোশাক প’রে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সেই সমস্ত দিন শ্রীমতী গান্ধীর শাসনকালে অবলুপ্ত; দুই ধারে তাঁর হিংস্র শত্রুদল, একদিকে আদি কংগ্রসের প্রবীণ নেতৃত্ব, যাঁদের তিনি একে-একে ঘায়েল করতে-করতে এতদূর এগিয়ে এসেছেন, এবং অন্যদিকে আদালতের বিচারপতিরা, কর্মক্ষেত্রে অবিরাম হস্তক্ষেপ ক’রে যাঁদের অহংবোধে তিনি আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে থাকেন। আদালত ও বিচারব্যবস্থাকে হেয় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগেই, এবং বিচারপতিরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই তখন থেকে ভারতের সংবিধানের মূল কাঠামোটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ক’রে চলেছিলেন [গোলকনাথ বনাম পঞ্জাব-র রাজ্য সরকার(১৯৬৭) এবং কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল-র রাজ্য সরকার (১৯৭৩) দ্রষ্টব্য]। এই দিক থেকে বিচার করলে, শ্রীমতী গান্ধী ও আইনব্যবস্থার দ্বৈরথে বিচারপতি সিংহ-র রায়, প্রধানমন্ত্রীকে উচিত শিক্ষা দেবার সাময়িক ভাবে সফল প্রয়াস। শিক্ষাগ্রহণের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী, খুব দ্রুত এবং চরম দক্ষতার সঙ্গে, প্রত্যাঘাত হানেন।
রাজধানীতে স্তাবকদ্বারা পরিবৃত হয়েও প্রধানমন্ত্রী তাঁদের একজনেরও উপর নির্ভর না ক’রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা আইনজ্ঞ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-কে কলকাতা থেকে ডেকে পাঠিয়ে সঙ্কটমোচনের পরামর্শ চান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অভিমত দেন; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অন্তত সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখাই আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী-র সঙ্গে এবার সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জোট বাঁধেন, তৈরি হয় নতুন এবং অত্যন্ত কার্যকরী এক দুষ্টচক্র। নকশালবাড়ি-অভ্যুত্থান পিষ্ট ক’রে মুখ্যমন্ত্রী রায়-এর যোগ্যতা ইত্যবসরে প্রমাণিত, রক্তমাখা হাত দু-খানি মুছে নিয়ে,জরুরী ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্থপতির ভূমিকায় এবার তিনি অবতীর্ণ হন। আইনের খুঁটিনাটিতে প্রবেশ না ক’রে আমরা কেবল দু’টি সূত্রের উল্লেখ করব, এক, ভারতের সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা, যেখানে জরুরী অবস্থার প্রেক্ষাপট ও বিধি আলোচিত হয়েছে, এবং, দুই, শ্রীমতী গান্ধীর আমলেই প্রবর্তিত ‘মেনটেনান্স অফ্ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ১৯৭১’, সংক্ষেপে ‘মিসা’। ‘প্রিভ়েন্টিভ় ডিটেক্শন অ্যাক্ট’ নামে ১৯৫০-র একটা পুরানো আইন ছিল, সেটাকেই পুনর্গঠিত ক’রে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী তাঁর অস্ত্রশালায় ‘মিসা’ মজুত রেখেছিলেন, কদাচিৎ ব্যবহৃত সেই অস্ত্রটি বার ক’রে আনেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। কোনও স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিনা বিচারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারারুদ্ধ করার উপায় শাসককুলের পক্ষে যে কত উপযোগী, ভারতের জরুরী অবস্থা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া আজ দুষ্কর; ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ অনুমান করেছেন ‘মিসা’য় আটক রাজবন্দীর সংখ্যা ছত্রিশ হাজার। অভিনেত্রী তথা সমাজকর্মী স্নেহলতা রেড্ডী-কে এমন অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রাখা হয় যে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য পেরোল-এ সাময়িক মুক্তিলাভের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি প্রাণ হারান। কেউ-কেউ সহজে ধরা দেন নি, পলাতক জর্জ ফরনান্ডেস্-কে গ্রেপ্তার করতে সরকারকে বিশেষ বেগ পেতে হয়েছিল।
১২ জুন-র এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার মাত্র দুই সপ্তাহ এবং নয়া দিল্লীর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার-এর স্টে অর্ডারের মাত্র একদিনের মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কররা আত্মরক্ষা ও প্রতি-আক্রমণের সব ক’টি ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলেন। জরুরী অবস্থা প্রবর্তনের তিনটি যুক্তি পেশ করা হয়; এক, দেশের অভ্যন্তরে অশান্ত পরিবেশকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা, দু্ই, বিদেশী আগ্রাসন থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাগ্রহণ, এবং, তিন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তরান্বিত করার দায়। এদের মধ্যে তৃতীয় যুক্তিটি বোধকরি, সবচেয়ে হাস্যকর। ১৯৭১-র নির্বাচনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-র বিপুল জয়ের পিছনে ‘গরীবি হটাও’ স্লোগান থেকে সঞ্চারিত স্বপ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং, যে-ভাবেই হোক, শ্রীমতী গান্ধী দেশবাসীকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরে দাঁড়িয়ে থেকে সরকারী প্রচেষ্টার আশানুরূপ ফল ফলছে না। তাঁর নিজের বিশ দফা কর্মসূচীর সঙ্গে তাঁর সুপুত্রের পাঁচ দফা কর্মসূচী জুড়ে দিয়ে, পঁচিশ দফা কর্মসূচী রূপায়ণ করবার জন্য, সেই সময়ে, শাসনযন্ত্রের পক্ষ থেকে সর্বশক্তি রেখে বাধ্যতামূলক ‘নসবন্দী’ এবং পুরানো দিল্লীর তুর্কমান গেটের বস্তি-উচ্ছেদ কার্যক্রম ― দু’টিই সঞ্জয় গান্ধী-র মস্তিষ্কপ্রসূত। দ্বিতীয় কারণটি, অর্থাৎ বিদেশী আগ্রাসন, একটি আড়াল হিসেবে কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর আগে, ভারতে যখনই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, ১৯৬২, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এ, তখনই, চীন হোক অথবা পাকিস্তান, কোনও-না-কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। শ্রীমতী গান্ধী এবারও সামরিক আক্রমণের ভীতিকে ব্যবহার করেন। প্রথম কারণটিকে, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সঙ্কট, মুখ্য কারণ হিসেবে আমরা আগেই শনাক্ত করেছি, কিন্তু এখানে বিশেষ ক’রে উল্লেখ করবার প্রয়োজন রয়েছে যে, কেবল এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায় নয়, তিনটি গণ-আন্দোলন শ্রীমতী গান্ধী-কে প্রবল রকমের ভীত করেছিল, ১৯৭৩-এ শুরু হওয়া গুজরাট-র ছাত্র আন্দোলন (‘নব নির্মাণ আন্দোলন’), বিহার-এ জয়প্রকাশ নারায়ণ-এর নেতৃাধীন অসহযোগ আন্দোলন(১৯৭৪)এবং জর্জ ফরনান্ডেস্-র নেতৃাধীন সারা ভারত ব্যাপী তিন সপ্তাহের রেল ধর্মঘট(১৯৭৪)।
।। ৩ ।।
জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার সময় বেতারে সম্প্রচারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত না-হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। দিল্লীর সংবাদপত্রের পাড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিন্ন হওয়ার কারণে দু’দিন ধ’রে খবরের কাগজ প্রকাশিত হতে পারে নি, বিরোধী দলগুলির নেতৃত্বের অনেকেই (বিশেষ ক’রে জনসঙ্ঘ দলের সদস্যদের, কারণ তখন তাঁরাই ছিলেন গান্ধী পরিবারের প্রধান প্রতিপক্ষ, এবং, বলার অপেক্ষা রাখে না, দক্ষিণ ও বাম উভয় প্রান্তের ছাত্রনেতা এবং বামপন্থী নেতৃত্বের একাংশ) ‘মিসা’-য় গ্রেপ্তার হন। এর উপরে, কড়া ধাঁচের সেন্সরশিপ বিধিনিষেধ প্রবর্তিত হয়। সেন্সরশিপের বিরোধিতা করবার জন্য জাতীয় এবং প্রাদেশিক স্তরের সংবাদপত্রগুলি প্রতিবাদজ্ঞাপনের দু’টি উপায় উদ্ভাবন করেন। সম্পাদকীয় রচনার পরিবর্তে, কোনও-কোনও সংবাদপত্র মহাত্মা গান্ধী-র অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচনা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার ক’রে বড়-বড় হরফে ছেপে দেন। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’-এর কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ সম্পাদকীয় রচনার বিকল্প হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কোনও-কোনও কাগজ মৌন প্রতিবাদের পথ বেছে নেন, সম্পূর্ণ ফাঁকা তাঁদের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা যেন এক শোকপ্রস্তাব হয়ে ওঠে! ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর ফাঁকা পৃষ্ঠার এদিকে-ওদিকে কোথাও একটি-দু’টি শব্দ, কোথাও একটি বাক্যাংশ সাজিয়ে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার এক ক্রুদ্ধ চেহারা ফুটিয়ে তোলেন সম্পাদক সমর সেন।
আমরা যে ঘটনাবলী স্মরণ করলাম, সে-সবই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর চোখের সামনে যখন ঘ’টে চলেছে তখন তিনি আর যুবক নন, বয়স পঞ্চান্ন বছরে এসে ঠেকেছে, অবশিষ্ট আয়ু মাত্র দশ বছর। তবু, তাঁর একটি বইয়ের শিরোনাম ধার ক’রে বলা যায়, ‘আর এক আরম্ভের জন্য’ তিনি আবার কলম ধরেছিলেন। আজ, জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে তাঁর চটি বইগুলি পড়তে গিয়ে আমরা নতুন ক’রে স্তম্ভিত হই। এই সমস্ত কবিতা, সময়ের দাবি মেটাবার জন্য পাথরকুচিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া এই সমস্ত অশ্রুবিন্দু, কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে ছাপাখানায় পৌঁছল কী ভাবে? এমন কি ঘ’টে থাকতে পারে, সেই সময়ের ‘প্রি-সেন্সরশিপ’ বিধি ভঙ্গ ক’রে তিনি সরকারী দপ্তরে পাণ্ডুলিপি জমা দিতেই অস্বীকার করেছিলেন এবং সরকারী অনুমতি না নিয়েই বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিল? না কি, পাণ্ডুলিপি পড়ার দায়িত্ব যে সরকারী কাব্যরসিকদের উপর বর্তেছিল, তাঁদের চশমাগুলি অফিসটেবিলের দেরাজেই রয়ে গেছিল? ‘পৃথিবী ঘুরছে’(প্রথম প্রকাশ:৭ নভেম্বর ১৯৭৫) এবং ‘শীত বসন্তের গল্প’(প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ১৯৭৭), উভয় বইতেই, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পর পৃষ্ঠা, এই সব লেখায় ভাস্বর :
এই যুদ্ধ
[‘... the blood ran down like rain,’]
বৃষ্টির মতোই রক্ত, এত রক্ত!
ঘাতক! তোমার
কুঠারে রক্তের ঢল নামে!তুমি
তোমার মতো এক হাজার পরশুরাম
সঙ্গে নিয়ে
কোন রক্তনদী করো আবিষ্কার?
আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, রক্তে স্থির শুয়ে থাকা
মৃত মানুষেরা
এই যুদ্ধে হয়েছে বিজয়ী।
[‘পৃথিবী ঘুরছে’ পৃষ্ঠা ১০]
জল থৈ থৈ
সুয়োরানী, দুয়োরানী, ঘুঁটে-কুড়নীর দেশে
যে হাসে সে কেবল হাসে, হেসেই বাঁচে না সে ―
যে কাঁদে সে কেবল কাঁদে, কেঁদেই মরে সে।
দেশের রাজা মস্ত রাজা, একশোটি তার রানী
একটি সুখে একটি দুঃখে, বাকিদের হয়রানী ―
দিন নেই রাত নেই তাদের চক্ষে ঝরে পানি।
চোখের পানি ঝরতে-ঝরতে জল থৈ থৈ দেশ
ঘর ভেসে যায় পথ ভেসে যায়, নেই বৃষ্টির শেষ
ভাবেন রাজা, এই ভালো, এই ঈশ্বরের নির্দেশ।
রাজধানীতে সুয়োরানীর ময়ূরপঙ্খী নাচে
দুয়োরানী ভাবেন নালিশ জানাবেন কার কাছে?
ভোর না হতে ঘুঁটে-কুড়নী ঘুঁটে কুড়তে গেছে।
দেশের রাজা মস্ত রাজা, একশোটি তার রানী
একটি সুখে একটি দুঃখে, বাকিদের হয়রানী―
জল থৈ থৈ রাত্রি এখন
চোখের জলের রাত্রি এখন...
[‘শীত বসন্তের গল্প’ পৃষ্ঠা ১০-১১]
গৌতম বসু
ঋণস্বীকার
১.‘পৃথিবী ঘুরছে’ (১৯৭৫)
২.‘শীত বসন্তের গল্প’ (১৯৭৭)
৩.‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ (১৯৮৫)
Comments
Post a Comment