বিদুর ব্লগজিন : সীমিতা মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা
সীমিতা মুখোপাধ্যায়-এর গুচ্ছ কবিতা
শেষ রাত
তোমার কণ্ঠস্বরের ধ্বনিতে ধ্বনিতে চুঁইয়ে পড়ছে
প্রগলভ রাত, আমরা আর সকাল দেখব না জেনে
ক্লীব হয়ে জেগে আছি একে অপরের চোখের তারায়,
আমাদের নিম্নাঙ্গ জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে,
শরীরের পাথর জুড়ে ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে কথারা—
আমি ছড়িয়ে দিয়েছি চুল জোনাকির দিকে,
রাতের রং ফুটে উঠছে স্তব্ধতার গায়ে,
আদিম পৃথিবী শেষ চিৎকার করে উঠছে মহাকাল কাঁপিয়ে!
ব্যর্থতার গ্রহ ছেড়ে আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি
কী এক ব্যথায়!
শেষ আলো
বিকেলের মরমি আলো ফুরিয়ে এলে
বাবুই পাখিটি জোনাকি সাজায় ঘর আলো করে।
নড়বড়ে আকাশের গায়ে নীলচে কালশিটে,
নারিকেল গাছটি হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ—
সে আর আগলাবে না কাউকে।
ঘুমের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও সুরক্ষিত নই—
এ-কথা ভেবে, আবার আমি পাশ ফিরে শুই।
দূষিত ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধেয়ে যায় স্বর্গের দিকে,
সমুদ্র এগিয়ে আসে এত বড়ো একটা হাঁ করে,
অ্যাসিডে গলে যায় সোনার ফসল।
তারপর সব আয়োজন শেষ হলে
কাঁটাঝোপে দেবদূত এসে বসে ঘাপটি মেরে!
এইসব চেয়ে থাকা
তোমাকে বলা হল না—
এমন একটি সটান আক্ষেপ নিয়ে
আমি হেঁটে চলে যাই তোমার ফেলে যাওয়া রাস্তা।
এতদিনে একে একে খুইয়ে ফেলেছি সব নেশা,
খেলে দিয়েছি তুরুপের তাস।
তবু দেখছি— নিম গাছের আড়াল থেকে
হাত নাড়তে নাড়তে অস্ত গেল চাঁদ,
রাতভাঙা কান্নার মতো একদল হাওয়া এসে বলল—
এই যে দেখছ, মহাকাশ, তুমি কি জান সে মৃত,
নক্ষত্রখচিত তার সার্কোফ্যাগাস?
আমারও তো ফুরিয়ে এল অক্ষরবেলা!
সমুদ্র যেমন আকাশের দিকে,
আকাশ যেমন সমুদ্রের দিকে
হাঁ করে চেয়ে থাকে—
ঠিক তেমনি করে জীবন-মৃত্যু
কাঁটাতারের দুই পাড় থেকে আর-একটি বার
দেখা হবে না আমাদের?
মেহফিল
তোমার বাতাসবাড়ির দেয়াল জুড়ে
সোনালি প্রজাপতিরা উড়ছে—
বৃষ্টিলগ্নে তাদের জন্ম।
আমার বর্ষা-ভাদর জ্বলে গেছে হেমন্তের পাতায়,
মেরুদণ্ডে হামাগুড়ি দিচ্ছে প্রগাঢ় শীত,
তোমার পছন্দের তালিকা থেকে
ঝরে পড়তে পড়তে
লিখে চলেছি এক প্রবল অসময় আর দেখছি—
জানালার কাচ বেয়ে ঊর্ধ্বগামী জলের স্রোত।
তোমাদের টুংটাং উল্লাসেরা ঠোকাঠুকি করতে করতে
মিলিয়ে যাচ্ছে এক ঝাপসা শহরের স্মৃতিকথায়!
জলের টুকরো
ঘরের কোণে এক টুকরো জল রেখে দেওয়া ভালো—
গভীর কুয়ো থেকে তুলে আনা, হিম।
এ পৃথিবীতে খুশির রোদ উঠলে সেই জলে
উদাত্ত আকাশ খেলবে, চিল ঘুরবে;
লায়লাক মাধুর্যে সেখানে কখনও শাপলা ফুটবে।
জলের শরীরে গুলে দিয়ো বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা—
লবনের মতো, একমুঠো শিউলির মতো।
রাত বাড়লে ওই জল ছড়িয়ে পড়বে
দমবন্ধ বাতাসে বাতাসে, কোনো স্যাঁতসেতে অসুখে;
মৃতের নিঃশ্বাসের মতো ঠাণ্ডা বুলিয়ে
সে ফিরে যাবে তার প্রগাঢ় জন্মগুহায়!
[] কবি পরিচিত
১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর হুগলী জেলার গরলগাছা গ্রামে জন্ম। বেড়ে ওঠা উক্ত জেলার উত্তরপাড়ায়। প্রাণী বিদ্যায় স্নাতকোত্তর হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থেকেছেন। আপতত দুটি কবিতার বই। প্রথমটি— 'যাপনচিত্র' থেকে ২০১৫ সালের কোলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত 'দশভুজা সার্কাস' ও দ্বিতীয় বই— 'অস্ট্রিক' থেকে ২০১৮ সালের কোলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত 'আমার অসময়গুলি'। এই জীবন নিয়ে, লেখা নিয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনা নেই— পরিকল্পনা ছিল না কোনো দিন। লেখাকে কবির নিজের নিয়তি মনে হয়।
Comments
Post a Comment