বিদুর ব্লগজিন : বধ্যমঞ্চ, যাকে বলি মাতৃভূমি



বধ্যমঞ্চ, যাকে বলি মাতৃভূমি
তথাগত 
                                   

 সে আমাদের ইস্কুলবেলা। লেফট ফ্রন্টের শেষ দিনগুলির সিলেবাস। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের সিলেবাসের কবি। সেই আমাদের সিলেবাসে এবং সিলেবাসের বাইরে পড়া প্রথম গদ্যকবিতা। বাংলার দিদিমণি বলেছিলেন ছন্দে কবিতা লেখা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের পরে আর কোনো বাঙালি কবি জন্মান নি যিনি কঠিন কাজটা সহজ করে করতে পারেন। আধুনিক কবিরা ছন্দে লিখতে পারেন না তাই গদ্যে লেখেন। 
তখন আমাদের পুনশ্চ পড়ে উঠবার বয়স নয়, তখন আমরা মিলহীনতা কাকে বলে জানি না, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি  কোন ছন্দে লেখা এসব তখনও জানা নেই। মুক্ত ছন্দ তো অনেক দূরের পথ। কেবল মধুসূদন পড়তে পড়তে মনে হ’ত অন্তমিল নেই তবু কেন সহজে মুখস্থ হয়ে যায়! অথচ কী সব কঠিন ভাষা তার! 
সেই আনকোরা বয়সে লম্বা লম্বা লাইন নিয়ে হাজির হল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। ‘রাস্তা কারও একার নয়’। এ কী আজগুবে নাম রে বাবা! কলের লাইনের ঝগড়া নাকি! রাস্তার উপর সারে সারে সাজানো কলসি বালতির লাইনে সোনা দা যেন হঠাৎ সাইকেল নিয়ে আছড়ে পড়েছে। কাকিমা মাসিমারা চিৎকার করে বলছে— রাস্তার এক পাশ ঘেঁষে চলতে পারিস না বাবান? সোনাদার সপাট উত্তর— রাস্তা কারো একার নয়। 
সোনাদার সাইকেলের মতোই আমদের সাজুগুজু করা কবিতার সারিবদ্ধতাকে চকিতে বে-লাইনে করে দিয়ে হাজির হয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাই দিদিমণির কথাগুলো মনে ধরত না। ছন্দ না থাকুক, এমনকি সহজে মুখস্থও না হোক, কী এক অজানা এলোমেলো উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল সে কবিতায়, আমাকে টানত। সে আমাদের এলোমেলো বয়স, সে আমাদের উচ্ছৃঙ্খল হবার বয়স। 

                                ২
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় বড়ো বেশি আত্মস্থ হয়ে গেছি, এতো স্থির, যেন বা সরকারি শৌচালয়ের পাশে পরিত্যক্ত সরকারি জলা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আজকাল আর ভালো লাগে না কিছু। জীবনানন্দ ছাড়া কী আর পড়ব! উৎপল বসু নিয়ে দিনমান কেটে যায়। কিম্বা গৌতম বসু পড়ি, অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে। আত্মহত্যার কথা মনে এলে ভাস্কর। আমার বিনয়পাঠ ফুরিয়ে গিয়েছে। আর যাঁর সাথে ছবি তোলে সকলে, যেন প্রস্তর মূর্তির পাশে দেহচঞ্চল নরম যুবতী, পাঁজড়ে দাঁড়ের শব্দ ছাড়া, আর শবের উপর শামিয়ানা–কিচ্ছু পড়ি না। 
এই যে এতোগুলো নাম নিলাম, এর মধ্যে বীরেন চাটুজ্জে কই? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা কতোকাল পড়িনা। কতকাল জনসংঘের থেকে দূরে সরে আছি। সেই স্নাতকোত্তর বেলাতেই, যাদবপুরের বামপন্থী বন্ধুরা ‘স্বার্থপর’ তকমা দেগে দিয়েছিল। ইন্ডিভিজুয়াল, পলায়নবাদী – তর্কের, তত্ত্বের কতো রকমফের।  আমি গ্রাম-গঞ্জের কম-জানা ছেলে, তবু এটুকু বুঝেছিলাম, সত্যিই তো, যে কবিতা অন্তর্লীন, তা তো আমাদের একাই করে দেয়, আমার মতো বড়ো একা। আর একতার সাধনা করেন যাঁরা, তাদের কাছে এই একা থাকা স্বার্থপরতা বৈ তো নয়। আমার সেই স্বার্থপরতার পড়ার টেবিলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলনা। কেবল স্মৃতিতে বেঁচেছিল মহাদেবের দুয়ার। কেবল স্মৃতিতে বেঁচেছিল আশ্চর্য ভাতের গন্ধ। আর মনে পড়ত রাস্তা কারও একার নয়। 
                     
                           ৩
তারপর এই সময় এল। সময়, যা শিল্পীকে পুনর্জীবিত করে। আমরা যুদ্ধ দেখিনি, আমরা মন্বন্তর দেখিনি, আমরা দেশভাগ দেখেছি। চোখের সামনে সারা দেশ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রাজা প্রকাশ্য দিবালোকে নিহত সৈনিকের নামে ভোট চাইছেন, পীড়িত নিরন্ন মানুষ চোদ্দপুরুষের প্রদীপ জ্বালানো ভিটের কাগজপত্র খুঁজে মরছেন টিনের তোরঙ্গে;  আমরা কবিতা পড়ছি। আমরা মুচি মেথরের সেবা নিতে নিতে ফেসবুকে শিল্পতত্ত্ব মারাচ্ছি। 
সারারাত বিনিদ্র, সারারাত পাইচারি করা, ভোরবেলা মনে পড়ে যায় ‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’। কাদের? রাজার? রাজার বন্ধুর? আমলার? কবির? সরকারি উকিলের? না কি পাহাড় জঙ্গল চা বাগানের সেই উনিশ লক্ষ বাঙালির? দেশ জুড়ে আরো কোটি কোটি সাঁওতাল পরগণা দাক্ষিণাত্য মেঘালয়! ঘরে থাকতে পারিনা, ফেসবুকে প্রাক্তন নকশালেরা বিপ্লব করে, দেশ-বিদেশি মদের নাম জানা যায়, দামী রেস্তোঁরার ঠিকানা, পিকাসোর কেচ্ছা। ছাত্রছাত্রীদের অসময়ে বাড়িতে ডেকে আনি। পড়ে শোনাই—

আঁধার যায় না। এক মন্ত্রী যায়, অন্য মন্ত্রী আসে 
কবির সভায়। তারা কবিতা পড়েনা, তবু
              তারা কবিতার সারাৎসার
ব্যাখ্যা করে! আঁধার যায়না। শুধু জন্মদিনে 
             কলকাতার আকাশে বাতাসে
ভুতুড়ে আলোর মতো ছায়া ফেলে মাননীয় মন্ত্রীদের 
              মুখের বাহার। 

একে বলে রাষ্ট্রদ্রোহী কবিতা, যেমন লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে। যেমন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জাপানে, ১৯১৬ সালে। আজ বাংলা কবিতায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার যদি কিছু প্রয়োজন, তা এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। বাংলাভাষায় আজ রাষ্টদ্রোহী কবি নেই। বাংলাভাষায় আজ ফোরামের বিরুদ্ধে ফোরাম আর বুকভরা ঈর্ষা। রাষ্ট্র তো রাষ্ট্রই হয়। রাষ্ট্রের বড়ো বা ছোটো হয়না, রাষ্ট্র এক অনিঃশেষ তত্ত্ব – মানুষকে শাসন করবার, ঘাসের বিছানায় আগুন লাগিয়ে দেবার। বাংলাভাষার অর্ধেক প্রতিভাবান কবি আজ বড়ো রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে বসে ছোট রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া মঞ্চে ক্যাবাড়ে নৃত্য করে। আর এই নির্লজ্জ সময় জন্মভূমি যখন বধ্যভূমির মতো অটল, স্তব্ধ, শুধু রাজমঞ্চে রঙ্গিলা নৃত্য করে, তখন পঞ্চাশ বছরের পুরনো কবিতা আমার নীরবতার দরজায় কড়া নাড়ে—

অসীম করুণা তার, ঐ বধ্যমঞ্চ, যাকে বলি মাতৃভূমি;
জল্লাদেরা প্রেম বিলায় কোলের শিশুকে, তাঁর লীলা!
কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের ভিতর রক্তপাত— 
মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, ‘রঙ্গিলা! রঙ্গিলা!
কী খেলা খেলিস তুই!’
যন্ত্রণায় বসুমতি ধনুকের মতো বেঁকে যায়—
বাজারে মহান নেতা ফেরি করে কার্ল মার্কস লেলিন স্টালিন গান্ধী 
                                     এক এক পয়সায়... 

এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন? লেলিন নয়? উচ্চারণটা লেনিন? তাহলে আপনি প্রগতিশীল শুয়োরের বাচ্চা। আগে হাতে জবাই হতেন, এখন উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে আপনাকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে জবাই করা হয়।
                                             
                             ৪
পঞ্চায়েত ভোটে এক ইংরাজির শিক্ষক, প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন, রেললাইনে তাঁর টুকরো টুকরো দেহ পড়েছিল। মনে পড়ে? কামদুনিতে বাইক মিছিল? কাগজ তো পড়েন! যাঁর বাড়িতে রবিবার পায়েস খেতে যান তাঁর ‘উন্নয়নের’ কবিতা পড়ে বীরভূমের বীরপুত্র কী সব নাকি কটুকথা বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতিবাদ টতিবাদ করে পত্র লেখেন। সে পত্র কোথায় গেল? আপনার সই আছে তাতে?  অতএব বন্ধু অনাগরিকের যন্ত্রণা নিয়ে আপনার যে কবিতা, পরিযায়ী শ্রমিকের বঞ্চনা নিয়ে আপনার যে হাহাকার— তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। শিল্পের যা সবচেয়ে বড়ো দ্রব্যগুণ, বিশ্বাসযোগ্যতা। অতয়েব আপনি কবিতা হারাবেন। আপনি একা হয়ে যাবেন। বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা নয়, অবিশ্বাসীর মতো একা। সেদিনের জন্য তুলে রাখুন বীরেন চাটুজ্জের এই কবিতা—

শুধু কি বয়েস গেছে? আমার কবিতা
আমাকে বিষণ্ণ করে বিদায় নিয়েছে!
সে বড়ো একাকী ছিল। আজ আমি একা। 
চারিদিকে নৈঃশব্দ শুধু! আহ্লাদিত অন্ধকার
                     মন্ত্রীত্ব পেয়েছে! 

                               ৫
ব্যস। এইটুকু থাক। ইঙ্গিতে রেখেছি কত কথা। এইতো শতবর্ষ এল, সরকারি মঞ্চ বাঁধা হবে, লিটিল কবি আর লিটিল কবিনী লবঙ্গলতার মতো দুলে দুলে আবৃত্তি করবেন– রাজা আসে যায় নীল জামা গায় লাল জামা গায়...

 


Comments