বিদুর ব্লগজিন : শতবর্ষে বীরেন্দ্র স্মরণ।। সব্যসাচী দেব
যদি আমি মাটিকে জানতাম
সব্যসাচী দেব
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রথমে ছিল একেবারেই আত্মকথন, বলা যায় ব্যক্তিগত দুর্গে বন্দীত্ব। তার ভাষা ছিল দুর্বল, ভঙ্গি ছিল শিথিল, অসংবৃত, অতিকথনে ভারাক্রান্ত। সেখান থেকে নিজেকেই বদলাতে বদলাতে তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন এক শাণিত অমোঘ লক্ষ্যভেদী ভাষাভঙ্গি। একবার তিনি লিখেছিলেন–ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে আমি যদি মাটিকে জানতাম। এটি কি আক্ষেপ! কিন্তু বানানো নয়।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এই মাটির পৃথিবীকে জানার, তার কাছে থাকা মানুষদের জানার চেষ্টা। কবিতা জুড়েই তাঁর এই অন্বেষণ। শুরুর সেই দিনগুলিতে যখন ব্যক্তিগত দুর্গে বন্দী রেখেছিলেন নিজেকেই, তখন তাঁর কবিতায় ছিল কিছু অনির্দিষ্ট প্রেমের কথা, ভাবালু রোম্যান্টিকতায় আকীর্ণ সেইসব কবিতায় কিন্তু ছিল না কোনো দূরাভিসারের কথা, তাঁর উপরে যাঁর প্রবল প্রভাব সেই জীবনানন্দের অতীতচারণা বা দারুচিনি দ্বীপও তাঁকে টানেনি। বিষ্ণু দে-র আর্টেমিসও তাঁর মনোহরণ করেনি।
বরং ছিল দৈনন্দিনের ভিতরেই বেদনা আনন্দ বিরহ বা প্রাপ্তির বাসনার উচ্চারণ, যদিও তাতে ছিল কেবল কল্পনারই বিচরণ, বাস্তবের স্পর্শ ছিল না। সেই অপরিণত রোম্যান্টিকতা থেকে সরে এসে তিনি হয়ত আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন অন্য এক প্রেমকে। বইয়ের নাম ছাব্বিশে জানুয়ারি বা সুভাষ বসুকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে তারই নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু দেশও তো একটা ধারণা মাত্র, যদি না মানচিত্রের বাইরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় তার নদী মাটি জল পাহাড় আর মানুষ। সেই মানুষকে জানার চেষ্টাতেই তিনি এসেছিলেন আদিবাসী জীবনের কাছে, প্রকৃতিকে জড়িয়ে তাদের যে জীবনানুরাগ তাকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। এই জীবনানুরাগকেই অভিহিত করা যায় ভালোবাসা বলে। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-তে আদিবাসী জনগণের কবিতার অনুবাদ নেই, যেমনটি করেছিলেন তাঁরই এক প্রিয় কবি বিষ্ণু দে। ভেরিয়ার এলউইনের ইংরিজি অনুবাদকে পাথেয় করে বিষ্ণু দে-র সেই প্রয়াস স্মরণীয় হয়ে আছে।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার বদলে আদিবাসী জীবনের সুর ছন্দ ও দর্শনকে রূপ দিতে চাইলেন তাঁর কবিতায়। হয়ত তা কৃত্রিম কিছুটা, ওই জীবনের কেউ না হয়ে নাগরিক পরিবেশে বাস করে সে জীবনকে পরিপূর্ণ বোঝা সম্ভব নয় ঠিকই। কিন্তু বাঙালি মধ্যশ্রেণির পশ্চিম-বিলাসে বারবার যে মধুপুর গিরিডি শিমূলতলা যাত্রা তার থেকে অনেকটা এগিয়ে এই প্রয়াস, অন্তত সে-জীবনকে পড়ার ইচ্ছেটা এখানে প্রবল। যদিও আদিবাসী জীবনের অজটিল অকপট উচ্চারণকে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন, আনন্দের সঙ্গে তাদের বেদনাও। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র এই অভিজ্ঞতা তাঁর সহায়ক হয়েছিল।
সে ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিশ্চয়ই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিরই। বামপন্থার প্রতি প্রায় সহজাত অনুরাগে গড়ে উঠেছিল হয়ত অন্তঃপ্রকৃতির তাড়নায়, তাঁর নিজের ভাষায় কিছুদিন কম্যুনিস্ট পার্টির ভলান্টিয়ারি করেছিলেন, অর্থাৎ মার্ক্সবাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। এই পরিচয় তাঁকে কোনো দলভুক্ত হতে প্ররোচিত করেনি, বরং এক প্রসারিত সহমর্মিতার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। সে সহমর্মিতা সাধারণ মানুষের প্রতি। অথচ এও তো তিনি জানতেন তাঁর প্রধান বেড়া হলো নিজের মধ্যশ্রেণিগত অবস্থান। জীবনে জীবন যোগ করা খুব সহজ নয়, যদি বা কাজের মধ্য দিয়ে কিছুটা এগনো যায়, শিল্পে তাকে প্রতিফলিত করা কঠিনতর কাজ। সেজন্যই অনেক কবিতা লেখার পরও তাঁর মনে হয় তিনি মাটিকে চেনেননি।
অথচ এই মাটির কাছেই তাঁর নিজেকেই সমর্পণ। মাটি মানে তাঁর চারপাশের পৃথিবী। পুঁথির ছাপা অক্ষর থেকে নয়, অভিজ্ঞতাকে অনুভবে রূপান্তরিত করে। তাঁর কাছে কবিতা মানে জীবনকে ছুঁয়ে থাকা, তাকে প্রতি নিঃশ্বাসে অনুভব করা। সেই জীবন কখনও সংগ্রামের, কখনও আনন্দের, কখনও পরাজয়ের, বেদনার, বিষাদের। তবু সেই জীবন তাঁর কবিতার একমাত্র অবলম্বন। ‘অন্য মহাশ্বেতা’ কবিতায় তাঁর এই অবলম্বনকে তিনি স্পষ্ট করে দেন, বলেন ‘তুমি সোনার কলস কাঁখে চলে যাও আমি মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না’। সোনার কলসে আছে অহংকারের জৌলুস, অনায়াসে কবি তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, জানিয়ে দেন মাটির কলসে অকৃত্রিম প্রাণের স্পর্শ আছে, সোনার কলসির জৌলুস প্রসাধন মাত্র, তাতে এই সত্য ঢাকা পড়ে না যে ‘... তোমার মুখে মানবীর লাবণ্য ছিল না’। তাহলে মাটি আসলে এক মানবিক অভিজ্ঞান! সেই মানবিক অভিজ্ঞান ছাড়া কবির, কবিতার পিপাসা মেটে না।
প্রথম পর্বে ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-তে তিনি আদিবাসী জীবনের রূপরসকে ধরতে চেয়েছিলেন, নিজের কবিতাকে তাঁদের অনুসারী করে তুলতে চেয়েছিলেন। সেটা একটা প্রয়াস হতে পারে, কিন্তু নাগরিক কবির পক্ষে তা সত্যিই অর্জন করা দুরূহ, অনভিপ্রেতও বটে। সেই আদিবাসী জীবনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র পুনরাবৃত্তি আর ঘটাননি। কিন্তু আদিবাসীরা, সে তাঁরা পৃথিবীর যে প্রান্তের বাসিন্দাই হোন, তাঁদের জীবন সম্পর্কে আগ্রহ তাঁর থেকেই যায়, কেননা এই মানুষগুলি আছেন প্রকৃতির সন্তান হয়ে। তাঁরা জীবনকে সোনার মোড়কে দেখেন না, দেখেন মাটি মেখে। নানা সময়ে কবি আগ্রহ দেখান সেই লোকসাহিত্য অনুবাদ করায়। তাঁর ‘সেই মানুষটি, যে ফসল ফলিয়েছিল’ ও ‘মহাপৃথিবীর কবিতা’-র বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই লোকজীবনের সাহিত্য। এও তাঁর মাটিকে ছোঁয়ারই এক চেষ্টা।
এই মৃত্তিকাস্পর্শ তাঁর কবিতার সবথেকে বড়ো পরিচয়। একে অন্যভাবে বলা যেতে পারে মানবতাবাদ, যদিও এই শব্দটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়ে তার দ্যোতনা হারিয়েছে। মাটিকে ছুঁতে চান তিনি, কিন্তু সব সময় যে খুব মধুর হয় সে অভিজ্ঞতা তা নয়, ব্যর্থতার যন্ত্রণাও সইতে হয় মাঝে মাঝে। ‘মাটিতে যাও, মাটির সঙ্গে জীবন মেলাও’ এই পথনির্দেশ পাওয়ার পরেও দেখা যায় ‘যেই দিয়েছে মাটিতে পা, পায়ে ঠেকল কঠিন শিলা’। কেন মাটি কঠিন হয়ে ওঠে? অপরিচয়ের ব্যবধানে? উত্তর নিজেই খুঁজে পান কবি ‘তার মাটিতে পা, মাটির সঙ্গে জীবন মিলল না’ (মাটি আমার মাটি/বেঁচে থাকার কবিতা)।
তাহলে কেবল মাটিতে পা রাখলেই হয় না। তা হয়ে উঠতে পারে শৌখিন মজদুরি। তার সঙ্গে জীবন মেলাতে হয়।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার দিকে তাকালেই বোঝা যায় কীভাবে এই জীবন মেলানোর প্রস্তুতি চলেছল তাঁর নিজের মধ্যে। শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কবিতায় মাটিজলের কথা উচ্চারিত হলেও অনেকের অনেক রচনায় বাণীর মহিমা থাকে, কিন্তু বাচনের অন্তঃস্পর্শিতা থাকে না। বলেছিলেন যে কোনো দায় বা কর্তব্যের বোধ থেকে না হয়ে ‘জীবনযাপনের নিজস্ব সত্য থেকে যখন জেগে ওঠে কবিতা’ তখনই কেবল তা ‘ছুঁয়ে যেতে পারে’ আমাদের। রবীন্দ্রনাথ কবেই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন জীবনে জীবন যোগ করতে না পারলে ‘কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা’। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেরকম কৃত্রিম পণ্য উৎপাদন করতে চাননি, তাঁর কবিতা ‘জীবনযাপনের নিজস্ব সত্য’ থেকেই উৎসারিত। প্রথমদিকের কবিতায় প্রেমানুভূতির পাশেই তো তাঁকে দেখতে হয়েছিল ‘আজও নামে দিকে দিকে আকালের ঝড়!/ ... ... আর জেগে বসে আছে কালো দুই পাখা মেলে কয়টি লোলুপ জানোয়ার....../উৎসাহী শকুন।/প্রতীক্ষা: নিশ্চিন্ত তৃপ্তি দিয়ে যাবে খাদ্যহীন শিশুদের খুন’। (বাঁকুড়া, ১৩৫২/২৬শে জানুয়ারি)। একি শুধু দুর্ভিক্ষের পরের অভিজ্ঞতা? নেহাৎই সাময়িক? তা যে নয় তা তো এই কবি জেনেছেন বারবার।
সেই জানা থেকে উঠে আসে ‘বেকার জীবনের পাঁচালি’ বা ‘কালো বস্তির পাঁচালি’। কিন্তু কেবল কি এই যন্ত্রণাই জীবনের সত্য? ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’-র রোম্যান্টিক প্রেম ও সৌন্দর্যের উচ্চারণের মাঝেও তাঁকে মনে করতে হয়েছিল ‘চাঁদের আলোয় পেট ভরে না/দাদারিয়া গানে পেট ভরে না’। কী কবিতা লিখবেন তবে কবি! কীভাবেই বা লিখবেন! এক টুকরো রুটি যখন হয়ে ওঠে সুদূর, এতটাই দূর ‘যেন নীল আকাশের চাঁদ’ তখন কবির আর্ত চিৎকার ছাড়া জীবনকে আর কীভাবে প্রকাশ করা যায়, নিরুপায় এই উচ্চারণই তখন একমাত্র সত্য–‘সকাল বিকেল একটি করে আস্ত রুটি চাই। যতরকম কবিতা চাস, লিখে দেব–‘।
না, এ কোনো দাসখত লিখে দেওয়া নয়। রুটির কাছে শিল্পও তুচ্ছ হয়ে যায়, এই সত্য কবিকে জানতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলেন কবি–‘কবিতাকে মন্ত্র করার নিয়ম/শিখতে আমার বয়স গেল’ (ভূতের ভয়/সভা ভেঙে গেলে), কিন্তু সময় আর পরিবেশ যেন ক্রমশ ক্রূরতর, তাই ব্যর্থতার দায়ও বইতে হয়। সেই ব্যর্থতাকে অতিক্রম করার একমাত্র পথ ওই মাটিকে চেনা, যে মাটিতে কবির শিকড়, সেই মাটিতেই জড়িয়ে আছে আরও অনেক জীবনকথা। সে জীবনক্র ছুঁতে চান কবি, ছুঁতে পেরেছেনও। মনে রেখেছিলেন ‘যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি’। বৃষ্টিকে আনতে হয়, কোনো দৈব প্রত্যাশায় ভর করে বসে থাকলে চলে না। বৃষ্টি আনার এক মন্ত্র তিনি শিখেছিলেন ‘মে-দিনের গানে’, লাল পতাকার রঙে। সেই তো তাঁর প্রেম, প্রেমের উচ্চারণ তিনি করতে চান আগুনে হাত রেখে।
মাটিকে চেনা তাহলে মানুষকে চেনা, জন্মভূমিকে চেনা। ‘রাস্তায় যে হেঁটে যায়’ সেই মানুষের জীবনকে চেনা। চেনা জানা এবং ভালোবাসা। ভালোবাসার কথাই তো বলতে চেয়েছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে। অনেক ব্যর্থতা পেরিয়ে তিনি বুঝেছেন–‘এই যে আগুন,/মানুষের পৃথিবী/আগে তার খিদে মেটা’। নইলে সব কবিতাই বৃথা। নিজেকেই তিনি বলেন ‘জীবনের পাঠ এখান থেকেই শুরু কর’। নইলে ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা কেবল অক্ষর সাজানো হয়েই থেকে যাবে।
সেই আক্ষেপ ছিল এক কবির সৎ স্বীকারোক্তি। সেখান থেকে অনেক পথ পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন মানুষের মুখের লাবণ্যে, আমাদের শিখিয়ে গেলেন ‘যেন আমাদের ভালোবাসা কবিতার আগুনে নম্র হয়, পবিত্র হয়–‘।
Comments
Post a Comment