সাক্ষাৎকার : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণের বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত‘ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে দরিদ্র, বুদ্ধিদীপ্ত, রোমান্টিক যে যুবক অপুর মানসমূর্তিটি আজ কল্পনায় অবধারিত ভাবে ভাস্বর হয়ে ওঠে সেটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। বাঙালি মননে ওই এপিক উপন্যাসের নায়ক আর অভিনেতা সৌমিত্র একাকার হয়ে গেছেন। অথবা ধরা যাক ‘অশনি সংকেত ‘-এর গঙ্গাচরণ চক্রবর্তী চরিত্রটি কিংবা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ গল্পের উমাপ্রসাদ, তারাশঙ্করের ‘অভিযান‘-এর নরসিংহ, ‘গণদেবতা‘-র দেবু পণ্ডিত, রবি ঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ, সমাপ্তি, নষ্টনীড় (চারুলতা), মাল্যদান, ঘরে বাইরে, বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরা, শরৎচন্দ্রের দেবদাস, পরিণীতা, দত্তা, মতি নন্দীর কোনি, সমরেশ বসুর সংসার সীমান্তে, সুনীল গাঙ্গুলীর অরণ্যের দিনরাত্রি প্রভৃতি অসংখ্য বিখ্যাত-অতি বিখ্যাত গল্প-উপন্যাসনির্ভর চলচ্চিত্রে নানা ধ্রুপদী চরিত্রে অভিনয় করতে করতে সৌমিত্র যেন সিনেমার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের এক প্রধান বাস্তব নায়ক হয়ে উঠেছেন।
সত্যজিতের ফেলুদা কাহিনিগুলোয়, লেখককৃত ফেলুদার কাল্পনিক ইলাস্ট্রেশন দেখলে মনে হয় না কি—যেন চরিত্রটির সৃষ্টি হয়েছিল সৌমিত্রের জন্যেই? ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসের প্রচ্ছদটি তৈরিও হয়েছিল ফেলুদাবেশী সৌমিত্রের ছবি দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সাতাশটি কাহিনিচিত্রের মধ্যে চোদ্দটিতেই প্রধান চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র। ফলে অনেকে তাঁকে সত্যজিতের অল্টার ইগো ভাবতেও পছন্দ করেন। সিরিয়াস ছবির পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয়ের সূত্রে আপামর বাঙালির কাছেও তাঁর অতুলনীয় জনপ্রিয়তা ছিল। সারা জীবনে প্রায় সাড়ে তিনশো ছবিতে অভিনয় করেছেন। মৃত্যুর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ ছবি ‘সাঁঝবাতি’। কয়েকটি ছবি এখনও মুক্তির প্রতীক্ষায়।
দীর্ঘদিন পেশাদারি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর বেশির ভাগ নাটক পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক। থিয়েটারের ভাষা নিয়ে নতুন ভাবে ভেবেছেন। টাইম এবং স্পেসকে কীভাবে নাটকে অন্যরকম করে ব্যবহার করা যায় তার প্রয়াস করেছেন। প্রথম নাটক ‘অতসী’। পরবর্তী ‘নামজীবন’ থেকে ‘ফেরা’, ‘নীলকণ্ঠ’, ‘টিকটিকি’, ‘প্রাণতপস্যা’, ‘হোমাপাখি’ প্রভৃতি নাটকে নিরীক্ষাময়তার এই ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। অশীতি বছরের প্রাক্কালেও নাট্যাভিনেতা সৌমিত্র শেকসপিয়রের ‘রাজা লিয়ার’ নাটকে পরিশ্রমসাধ্য অসামান্য অভিনয়ে বিস্মিত করেছেন দর্শকদের।
অভিনয় ছাড়া সাহিত্যক্ষেত্রেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনায়াস বিচরণ নতুন করে বলার নয়। কবিতা, নাটক ও নানা বিষয়ক গদ্য লেখায় তাঁর কলম আমৃত্যু সচল ছিল। প্রকাশিত হয়েছে গদ্যসমগ্র, কবিতাসমগ্র, নাটকসমগ্র। বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে ‘এক্ষণ’ নামে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন। বিশ শতকের বৃহৎ মাপের বাঙালির এই প্রায় শেষ প্রতিনিধির সাম্প্রতিক প্রয়াণে আপাতত আমরা মুহ্যমান হয়ে আছি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই কথোপকথন আমার বেশ কয়েক বছর আগের। ২০০২-এর। তাঁর নিজের রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘প্রাণতপস্যা’-র অভিনয়-সূত্রে তাঁকে আমার শহর নবদ্বীপে পেয়েছিলাম। শান্তিনিকেতনি কারুকাজ করা ক্রিম শেডের আজানুলম্বিত পাঞ্জাবি গায়ে সুদর্শন সুঋজু সৌমিত্র মফসসল হোটেলের অপরিসর ঘরে খাটের ওপর বসেছিলেন। এক আন্তরিক নির্জনতায় তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল :
— আপনার বাল্য ও কৈশোর তো কৃষ্ণনগরেই কেটেছে।
— না, কৈশোর কাটেনি। ১৯৩৫-এ আমার জন্ম, ১৯৪৫-এর গোড়ায় আমাকে কৃষ্ণনগর ছাড়তে হয়। বাবার চাকরি-সূত্রে প্রথমে বারাসাত, তারপর হাওড়া, তারপর দার্জিলিং, কিছুদিন আবার কৃষ্ণনগর, তারপর আবার হাওড়া— তারপর হাওড়ার জেলা স্কুল থেকে আমি 'ম্যাট্রিকুলেশন' পাশ করি।
— নদিয়া জেলার কোনো সাংস্কৃতিক প্রভাব কি আপনার মধ্যে কাজ করেছে?
— সাংস্কৃতিক প্রভাব তো খানিকটা ছিলই। তবে সেটা অবচেতন মনের ওপরেই ছিল। সচেতন-ভাবে যে আমি কিছু গ্রহণ করেছি তা মনে হয় না। মনের ভেতরে একটা গৌরববোধ ছিল যে আমার বাড়ি কৃষ্ণনগর, সেখানকার একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, কৃষ্ণনগর, নদিয়া, নবদ্বীপ সব মিলিয়ে আর কী। প্রমথ চৌধুরী যে বলেছিলেন আমি কৃষ্ণনাগরিক, সেটা পরে যখন পড়েছি, তখন আমারও গর্ববোধ হয়েছে।
আমাদের আদি দেশ ছিল কুষ্টিয়ার ওপারে কয়াগ্রামে। আমার দাদু যেখান থেকে এসে কৃষ্ণনগরে বাড়ি করেন। জায়গাটা আগে নদিয়াতেই ছিল, এখন বাংলাদেশে। কয়াগ্রাম ছিল শিলাইদহের খুব কাছে এবং আমার দাদু ছিলেন ঠাকুরবাড়ির এস্টেটের উকিল। সেই সূত্রেও তার কোনও প্রভাব হয়তো মনের মধ্যে ছিল।
— এখানকার বিশেষ কোনও ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনুভব করেন?
— না, সেভাবে ডিরেক্টলি কারও প্রভাব আমার মধ্যে পড়েনি।
— ধরুন ডি. এল. রায় ...
— না, সেগুলো সব বড় হয়ে, যখন এম.এ.-টেমে পড়ছি, তাঁর নাটকগুলো পড়েছি, জেনেছি। কিন্তু কৃষ্ণনগরের প্রভাব একটা ছিল কারণ, আমাদের ছোটোবেলাতেই, সেখানে প্রচুর নাট্যাভিনয় হত, সেটা হয়তো দ্বিজেন্দ্রলালের শহর অথবা অন্য কোনও কারণেই হোক, সচেতনভাবে জানি না, কিন্তু সেই অভিনয়টা হত বলেই আমার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ কৃষ্ণনগরে ছোটোবেলাতেই জন্মেছিল।
— বাড়িতে কেউ অভিনয় করতেন?
— হ্যাঁ, আমার বাড়িতে সবাই অভিনয় ভালোবাসতেন, আমার বাবা ভালো অভিনয় করতেন, আমার দাদু অভিনয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং আমাদেরও অভিনয় করতে উৎসাহ দেওয়া হত।
— আপনার প্রথম সিনেমায় অভিনয় তো সত্যজিতের ছবিতেই ?
— হ্যাঁ, ১৯৫৮ সালে। 'অপুর সংসার' ছবিতে।
— আপনার অভিনয়-জীবনে বিশেষ কারও প্রভাব আছে বলে মনে হয় ?
— হ্যাঁ, অনেকেরই প্রভাব হয়তো আছে। তবে যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে আমি প্রভাবিত এবং যিনি আমার কাছে আদর্শ ও সবচেয়ে বড়ো অভিনেতা হিসেবে বিবেচিত— তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ী।
— নাটক এবং সিনেমা —দুটো মাধ্যমের মধ্যে কোনটি আপনার বেশি পছন্দ ?
— অভিনয় করতে আমার দুটোতেই খুব ভাল লাগে। ছোটোবেলা থেকে তো নাটকই করতাম। সিনেমা সম্পর্কে আমার আগ্রহ বরাবরই ছিল। কিন্তু সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ তো নাটকের মতো ওভাবে আসে না। খুব ছোটো থেকেই আমি সিনেমা দেখতাম এবং সিনেমা দেখতে আমার খুব ভাল লাগত। দুটোই আমার কাছে অভিনয়ের দিক থেকে খুবই আকর্ষণীয় আর কী।
— সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হল ? এখন এটা অনেকেরই জানা তবু আবারও জিজ্ঞেস করছি।
— উনি অপরাজিত ছবির জন্য অপু খুঁজছিলেন। সেসময় তাঁর একজন সহকারী আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যায়। সে আমার এক বন্ধু ছিল। সেই সূত্রে আর কী। আমি তখন সেই ভূমিকার জন্য অনেক বড়ো বলে বিবেচিত হই, মানে আমি নির্বাচিত হই না। পরে উনি যখন তৃতীয় ভাগ করবেন বলে ভাবেন অপুকে নিয়ে, তখন আমাকে ডেকে পাঠান। পরে শুনেছি, আমাকে দেখে উনি ঠিক করেছিলেন যে তৃতীয় ভাগ করবেন।
— ভালো অভিনয়ের সঙ্গে ভালো চিত্রনাট্যের সম্পর্ক কতটা ?
— সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে। ওটা তো গণ্ডি। ওটার মধ্যে থেকেই অভিনেতাকে যা-কিছু করতে হয়। তাই ওই গণ্ডিটা ভালো হওয়া তো অবশ্যই জরুরি।
— সাহিত্যনির্ভর কাহিনি-চিত্রগুলোতে অভিনয় করতে করতে আপনি দর্শকদের কাছে তো বাংলা সাহিত্যেরও অন্যতম নায়ক হয়ে উঠেছেন, এ-ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কীরকম ?
— সেটা আমি তো বলতে পারব না, আমাকে যেভাবে দর্শক গ্রহণ করেছে ...
— আপনার নিজের কেমন লাগে ?
— একটা সুবিধা হয়, সাহিত্যের চরিত্র পেলে সেটা নিয়ে ভাববার বা খাটবার অবকাশ থাকে। অনেক সময়, এখন তো বটেই, আগেও এটা হয়েছে, যে-সব চরিত্র সাহিত্য থেকে আহৃত নয়, সাহিত্য যার ভিত্তি নয়, সে-সব চরিত্রে সারবস্তু কম থাকে, তাই সেগুলোর অভিনয় করতে ভালো লাগে না বিশেষ।
— তার মানে উৎকৃষ্ট সিনেমা আসলে সাহিত্যের ওপরেই শুধু নির্ভরশীল?
— আসলে চিত্রনাট্য ইটসেলফ সাহিত্য হতে পারে। আমাদের দেশে সাহিত্যের এই শাখাটা গড়েই ওঠেনি। সাহিত্যের মূল্য পেতে পারে এমন চিত্রনাট্য খুব কম লেখা হয়েছে।
— ইদানিংকালে নাটকও সেভাবে সাহিত্যের মর্যাদা পায় না।
— নাটককে সাহিত্য হিসাবে গণ্য না করার কোনও কারণ নেই। নাটক তো সাহিত্যেরই একটা ভ্যালিড শাখা।
— না, আমাদের সাহিত্য জগতের কথা বলছি।
— এটা আমাদের ব্যাকওয়ার্ডনেস। শেক্সপিয়ারের চেয়ে উন্নত সাহিত্য আর কী হতে পারে ? কোনো ব্রাঞ্চ অফ সাহিত্যই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। রবীন্দ্রনাথ এতগুলো নাটক লিখেছেন, গিরিশ ঘোষ লিখেছেন ...
— রবীন্দ্রনাথ, গিরিশ, দ্বিজেন্দ্রলাল পর্যন্ত সাহিত্য হিসাবে নাটকের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে...
— এঁদের নাটকগুলো সাহিত্য হিসাবে মেনে নিলে বাকিগুলো কী দোষ করেছে? বাকিগুলো সাহিত্য পদবাচ্য হয়েছে কি না সেটা বিবেচ্য।
— সে তো গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন।
— হ্যাঁ, একই প্রশ্ন। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনেক নাটকই আছে সাহিত্য পদবাচ্য তো অবশ্যই। মনোজ মিত্রের বহু নাটক আছে, বাদল সরকারের কিছু নাটক আছে। এসব কাজ তো হয়েছে। এই যে 'অমিতাক্ষর' বলে যে নাটকটা হয়েছে, খুবই ভালো সাহিত্য। নাটক সাহিত্যের একটা শাখা। কিন্তু চিত্রনাট্যের শাখাটা আমাদের গড়েই ওঠেনি ভালো করে। অরিজিনাল চিত্রনাট্যের কথা বলছি। সাহিত্যের চিত্রনাট্য তৈরি করা, একটা জিনিস— নিশ্চয়ই সেটাও খুব প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু অরিজিনাল চিত্রনাট্য হিসেবে লেখা, যেমন ভাবে ধরুন জাভাত্তিনি লিখেছেন, রসেলিনি লিখেছেন, ডি সিকা লিখেছেন, পাসোলিনি লিখেছেন। পাসোলিনি এবং জাভাত্তিনি সব থেকে বেশি লিখেছেন। অথবা ধরুন বার্গম্যান লিখেছেন। সেরকম ভাবে আমাদের এখানে খুব কম কাজ হয়েছে। আমাদের এখানে সত্যজিৎ রায় কয়েকটা লিখেছেন। বিশেষ করে শেষের দিকে। গোড়াতে ‘নায়ক’ ইত্যাদি কিছু।
— এই যে কিছুদিন আগে 'দেখা' ছবিটি করলেন, ওটা তো মনে হয় অরিজিনাল চিত্রনাট্য।
— হ্যাঁ, অরিজিনাল চিত্রনাট্য। ওটা কোনও সাহিত্য থেকে আহরিত নয়। কোলাবরেট করে দুজনে লিখেছিলেন। গৌতম এবং সুনীল।
— সিরিয়াস চিত্র পরিচালকদের পাশাপাশি নায়ক-প্রধান বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করতে কেমন লাগে ?
— পেশার বৈচিত্র্য এটা আমাদের। সব দেশে সব সময়েই করতে হয়। হলিউডের বড়ো অভিনেতারাও কি সেখানে সবসময় ভালো ছবি পেয়েছে? তা তো পায় না। আমাদের এখানে আমি যখন ফিল্মে এসেছিলাম তখন অব্দি একটা সুযোগ ছিল, যেটা মেইন-স্ট্রিম সিনেমা, তাতেও অনেক ভালো ভালো পরিচালক ছিলেন। তপন সিনহা তো ছিলেনই। অসিত সেন ছিলেন, অজয় কর ছিলেন— এঁরা অত্যন্ত ভালো পরিচালক।
— কিন্তু এখন যাঁরা পরিচালক রয়েছেন ...
— এঁদের সাথে সত্যজিৎ রায় প্রভৃতিদের তুলনা টানাই উচিত নয়। এখন তো সামগ্রিক ভাবে বাংলা সিনেমারই অবনমন, অধঃপতন চলছে।
— এসব ছবিতে অভিনয় করতে কেমন লাগে?
— অভিনয় করতে তো ভালো লাগতে পারে না। এটা তো আমাদের পেশা।
— এসব ছবির জন্য কীরকম প্রস্তুতি নেন?
— বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। যখন সেরকম ছবি পাই, যেমন—'দেখা', তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় বৈকি।
— কিন্তু অনেক দর্শকের তো মনে হতে পারে, যে-মানুষ 'অপুর সংসার' করেছেন, 'চারুলতা' করেছেন, 'আতঙ্ক' বা 'অগ্রদানী' করেছেন, তিনি আবার এইসব এলোমেলো ছবিতে কী করে অভিনয় করেন।
— এটা তো পেশাগত কারণে। কোনও দেশে কোনও অভিনেতার কি এটা না করে উপায় আছে? যে-কোনও সময়, শেক্সপিয়ারের সময়েও কোনও অভিনেতাকে শেক্সপিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বাজে নাটকও তো করতে হত। যাবে কোথায় ! এটাই তো তাঁর পেশা।
— আপনার নাটক তো একটু অন্য ধরনের। সাধারণ বাণিজ্যিক থিয়েটার থেকে আলাদা। গ্রুপ থিয়েটারের কোনও প্রভাব কি আপনার নাটকে আছে ?
— না, আমি চিরকাল পেশাদার হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। পেশাদার নাটক করেছি। যাঁদের দেখে অভিনেতা বা নাট্য-পরিচালক হয়ে উঠতে চেয়েছি, তাঁরাও পেশাদার মঞ্চের লোক। তবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্য ধরনের নাটকে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকের আমি হয়তো গুণগ্রাহী ছিলাম, যেমন— শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ। আমার থিয়েটারে আসার মূল প্রেরণাটা পেশাদার থিয়েটার থেকে।
— পাশাপাশি আপনি তো লিটল ম্যাগাজিন করেছেন।
— কারণ আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্য ভালোবাসি।
— কিন্তু আপনি সাহিত্যের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক কাছাকাছি ছিলেন।
— প্রতিষ্ঠান বলতে?
— যেমন ধরুন আনন্দবাজার, আজকাল ...
— না, এই ধরনের সংবাদপত্রের সঙ্গে আমি কোনোকালেই যুক্ত ছিলাম না।
— কাছাকাছি ছিলেন।
— না, কাছাকাছিও ছিলাম না। ওসব থেকে আমি অনেক দূরেই ছিলাম বলতে পারেন।
— শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই আপনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
— শক্তির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল ব্যক্তি হিসাবে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কারণে নয়। ইনফ্যাক্ট, শক্তি আনন্দবাজারে কী চাকরি করত তা-ই আমি জানি না। সুনীল আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ত। একসঙ্গে ছাত্র ফেডারেশন করেছি, বহুদিনের বন্ধু। শক্তিও তাই। সতেরো বছর বয়সে, আমরা যখন থেকে কলেজে উঠেছি— সেসময় থেকে বন্ধু। তার সাথে আনন্দবাজার বা আজকাল ইত্যাদির কোনও সম্পর্ক নেই।
— 'এক্ষণ' পত্রিকার শেষের দিকে তো আপনি যুক্ত ছিলেন না।
— না, একদম শেষের দিকে ছিলাম না।
— 'এক্ষণ' কি আবার বেরুবে ?
— না, নির্মল্যের মৃত্যুর পর ওটা আর সম্ভব নয়। নির্মাল্য পরের দিকে তো একাই চালাত এবং সেটা চালাবার মতো ক্ষমতা তার ছিল। তার মনমতো করেই 'এক্ষণ' বের হত।
— আচ্ছা, এখানে এই 'প্রাণতপস্যা' নাটকের আয়োজক যারা, সেই নাট্য উন্নয়ন পরিষদের পরিচালনায় নবদ্বীপে একটা নাট্য সম্মেলন হয়, এখানে গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শে বিশ্বাসী পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অখ্যাত নাট্যদল অংশগ্রহণ করে। এই নাট্য উদ্যোগের পাশাপাশি আপনার যে নাট্য চর্চা— তা কি, যেমন লিটল ম্যাগাজিন এবং বড়ো বাণিজ্যিক পত্রিকা—এভাবে ভাবা যেতে পারে ?
— আমার তো মনে হয়, ভাবা উচিত নয়। কেন না, দুটো একদম অন্য— আলাদা ক্ষেত্র। দ্বিতীয় কথা, এখানে আপনাদের সম্মেলন কীরকম হয় না-হয় সে বিষয়ে আমার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। সুতরাং আমার নাটকের হিসেবে এ-বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।
— নতুন অভিনেতাদের জন্য কিছু বলবেন ?
— দেখুন, আমি অনেকদিন ধরে অভিনয় করছি, সেই অধিকারে কাউকে জ্ঞান দেওয়া ঠিক নয়।
— জ্ঞান নয়, পরামর্শ।
— পরামর্শ একটাই। কাজটাকে ভালোবাসা। কাজটার ভেতরে ডুবে থাকা।
— আর একটা প্রশ্ন, ইদানিং কাগজে পড়ছি, যাঁরা অনাবাসী বাঙালি আছেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের ব্যাপারে এগিয়ে আসছেন— সেরকম, আপনারা যাঁরা, নদিয়া জেলায় জন্ম কিন্তু জেলার বাইরে আছেন, তাঁরা কি জেলার উন্নতির জন্য কিছু ভাবতে পারেন ?
— তাঁরা, মানে অন্যদের কথা তো বলতে পারব না।নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, এখন এ-বয়সে এসে আমার সেরকম কিছু ভাবার মতো অবকাশ নেই। অভিনয়ের কাজে, পারিবারিক কাজে, নিজের ব্যক্তিগত কাজে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, জেলার জন্য বিশেষভাবে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না। দ্বিতীয় কথা, সেটা করলে বোধ হয় ভালোও হয় না। কোনও বিষয়ে অগ্রসর হবার কোনও তাগিদ যদি সেই জেলাতেই না থাকে তবে বাইরে থেকে কিছু করা যায় না। তবে কেউ যদি গিয়ে বলে, আমার সাধ্যের মধ্যে হলে সহযোগিতা করতে পারি। তবে উদ্যোগ এবং তাগিদটা এখান থেকেই আসতে হবে।
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
— ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment