বিদুর ব্লগজিন।। শীর্ষা-র গুচ্ছ কবিতা।।



চক্ষুশিকার

১ 
বালিকার চোখের মতো মেঘ উড়ে যাচ্ছে আকাশে। তুমি তাকে ধরবার চেষ্টা করতে গিয়ে গোড়ালিদুটোকে গাছ বানিয়ে ফেলছ— বৃক্ষ! তবু ছুঁতে পারছ না। তোমার এই বৃক্ষ হবার প্রচেষ্টাটুকুতেই খুশি হয়ে মেঘেরা তোমাকে সামান্য জলদান করে গেল। তুমি দেখলে তোমার শরীরের ওপর ঝরে পড়ছে অজস্র বালিকার খুবলানো দুটি চোখ।

২ 
তুমি না না করে উঠলে। সাধারণত না-কে হ্যাঁ বলা ধরে নিয়ে বালিকার উপড়ে আসা খুবলে আসা চোখ তোমাকে জননী বলে স্বীকার করে নিল।

৩ 
গাছে বসা একটি অদ্ভুত পাখি তার স্থিরচোখ দিয়ে গোটা ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করছিল। উপড়ে আসা চোখগুলোকে দেখে পাখিটি ভয় পেল না। তার চোখে ঘাড় অবধি চুলের বন্যাওয়ালা পেশীবহুল একটি পুরুষের মুখ ভেসে উঠল। লোকে তাকে অর্জুন বলে ডাকে। 

৪ 
একটি পাতাওলা গাছ, অজস্র খুবলানো চোখ এবং অদ্ভুত পাখির গল্পটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তিটি দেখছিল এবং সিনেমা বানাবে ভাবছিল, তার কাঁধে মস্ত এক জাল। তিনরকম চোখের বিশেষ সমাহার তাকে অভিভূত করেছে। তাই সে অত্যধিক যত্ন-আগ্রহ জমিয়ে জালটি পেতে দিচ্ছে মাটিতে। টান টান করে। চোখ ধরবে বলে।

৫ 
সুতোর ভেতর সুতো বুনে আয়ু জমিয়ে রাখা জালটি ফাঁদের নিন্দা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে বরাবর। টানটান হাত পা মেলা অবস্থায় শুয়ে সে সেদিনের মতো ছুটির নিঃশ্বাস ফেলল। আর তখনই দেখতে পেল অসংখ্য বালিকার বয়স মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে মালিকের চোখে – পৃথিবীর বৃহত্তম ফাঁদে আটকে আছে চোখ ধরতে আসা ক্ষুদ্র শিকারীর কুতকুতে দুটি চোখ।


শমীবৃক্ষের গান

১ 
কালের ঘন্টা গলায় বেঁধে ছুটতে থাকে 
সৌরমণ্ডল নামের গোরুটি, একেকটা দিন
তার খুরে পিষে গিয়ে পটাপট মরে যায়। 
আমাদের গার্হস্থ্যকে ঘিরে যত কলরব আদেখলাপনা করে, 
তাদের সবার চেহারা এক— একই পশু, একই মানুষ। 
আমাদের ঘরের মধ্যেও একই প্রাণী; 
চুমু খায়, হাসে, কাঁদে, জড়াজড়ি করে ভাদ্রমাস 
পার করে দেয় আরামসে। শুধু ঠুনকো আয়নার বেইমান স্বচ্ছতার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই 
একক মুখটি কি ভীষণ আলাদারকম 
দুজন হয়ে ওঠে  


আমার চারপাশে যত দরজা-জানালা আছে, দেওয়াল আছে— আমি সবকিছু ফুঁড়েই যাতায়াত করতে পারি। দেওয়ালের সলিড পাঁজর, কিংবা বন্ধ দরজার নগ্ন কাঠের পিঠ— কেউই আমাকে থামাতে পারেনি কখনও। শুধু যখন হঠাৎ করেই কোন এক সন্ধ্যেবেলায় বৃষ্টি নামে এক গায়েপড়া মেয়ে এসে আমার হাতেপায়ে চুমু খায়, উঠোন থেকে ভেসে আসা সাদাফুলের গন্ধ তাড়া করে আমাকে, আমি দেখি ওই সামান্য দেওয়ালে বা দরজার শরীরে আটকে গেছি আমি। আর আমার হাতে পায়ে কপালে একটি একটি করে পেরেক ঠুকছে কেউ। তার হাতুড়িতে খ্রিষ্ট নামে এক বুড়োর থুথু মাখা।  

মায়া— শব্দটির পায়ে জমা রাখছি হরিণের চামড়া। চামড়ার ফুল। খুরের চলে যাওয়া। বন্ধকী স্বপ্নের কাছে বিক্রি হচ্ছে আমার দোষ মাখানো গাছ। বয়োবৃদ্ধি হচ্ছে গাছের প্রতি রাতে। এভাবেই একটি অদৃশ্য সাপবোমের কুণ্ডলী দূষিত করছে সমস্ত অন্ধকারের শহরকে। বেলফুলের মালা দিয়ে অতীব বুদ্ধিমান বাতাস ঢেকে দিচ্ছে ভকভকে গন্ধ ওঠা মৃত শরীরের নিভে যাওয়া রঙকে। কেউ টেরও পাচ্ছে না। মায়া শব্দের কাছে জমা রাখছি আমরা আমাদের কান। নাক। সকল ইন্দ্রিয়ক্ষমতার মন্ত্রপূত সুতো।


মাটির জরায়ু ফেটে বেরিয়ে আসছে স্বপ্নিল গাছ। এতটাই নিষ্ঠুর যে নাভির প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা নেই— অথচ ঘুম ভাঙলেই ঠিক উড়ে যাচ্ছে পাখিটি। তার চেহারা ধরতে গিয়ে হেরে যাচ্ছে চোখের শেপওয়ালা পাতার ভিড়। তার রঙটিও অলীকের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। অতএব গাছটি আয়নাতেই কল্পনা করে নিচ্ছে একটি সন্তোষের জঙ্গল। একটি অবৈধ পুষ্টির আস্ত আপেলবাগান।

Comments