বিদুর ব্লগজিন || করতলে আকাশ পেতেছি : পঙ্কজকুমার বড়াল || পাঠ-প্রতিক্রিয়া: পঙ্কজ চক্রবর্তী

একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া।। পঙ্কজ চক্রবর্তী 

লুপ্ত অক্ষরের মায়াবী জীবন

 

পঙ্কজকুমার বড়াল প্রথম দশকের বাংলা কবিতায় একটি প্রতিশ্রুতির নাম। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই এক নিশ্চিত পদক্ষেপ। আমরা অনেকেই তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক। সবিস্ময়ে লক্ষ করেছি কবিতা জীবনের প্রাথমিক পর্বেই তিনি নিজস্ব এক সুর নিয়ে এসেছেন। প্রকৃতির এক সুদূর পাঠক তিনি, মুগ্ধ এক দৃশ্যনির্মাতা। একটি-দুটি রেখাচিত্রে তিনি জায়মান প্রকৃতির ছবি আঁকেন । পথ চলতে চলতে কুড়িয়ে নেন সজল শ্রাবণের লোকায়ত ছবি। অলক্ত এক পায়ের নুপূর। ফলত স্নিগ্ধ এক মায়ার দিগন্ত তাঁর কবিতার প্রধান সৌন্দর্য। এই পথ তিনি নিজের জীবন দিয়ে নির্মান করেছেন। কোনো আরোপিত ভণ্ডামি তাঁর কবিতায় নেই।  আসলে তিনি কবিতায় বিভূতিভূষণের সন্তান, জীবনানন্দের নিবিড় আত্মীয় কখনও।

 ছোটো ছোটো নির্মেদ বাক্যে পঙ্কজ আঁকেন নিসর্গের ছবি। তাঁর একপ্রান্তে সুদূর প্রকৃতি অন্যপ্রান্তে জীবনের নানা টুকরো মুহূর্ত। যেন এক 'শ্রাবণসন্ন্যাসী'  পেরিয়ে যাচ্ছেন জীবনের দিগন্ত মানুষের হাত ধরে। কোনো বিবমিষা নেই, অভিযোগ নেই শুধু এক সুদূর দৃশ্যমানতা আছে। পঙ্কজ এই নিসর্গ জলছবির প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন কবি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ'করতলে আকাশ পেতেছি'(২০১৮) আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে না-বলা অনেক কথা দিয়ে।

 "শিকারি বকের মতো নির্জন সন্ধ্যা

একটি জারুল গাছ

 চুল খুলে বৃষ্টিতে ভেজে

একটানা শব্দহীন

ছাদের কার্নিশ বেয়ে

নেমে আসে ধারা

 

তখন কোথাও ঝম্ ঝম্ ট্রেন চলে যায়।"

 কিংবা,

 "শ্রাবণ নামে

ঘড়ির ডায়াল থেকে

উড়ে যায় সময়ের ডানা

দুটি বালিহাঁস জলে নামে

অফুরান ডুব সাঁতার, চঞ্চু বিনিময়

না দেখা পাখির গান...

একটি গাছ নদীর শিয়রে বসে

স্বপ্নে আঁকে অলীক বাগান।"

কি়ংবা,

 "বীজের ভিতরে যে আদিম বনানী

সেইখানে ডেকে ওঠে বিপুল ম্যামথ

তুমি হেঁটে আসো

আমি তোমার সন্ধিপদে এঁকে দিই

অলক্ত ও আশ্চর্য নুপূর।"

পঙ্কজের কবিতায় কোনো রাজনৈতিক ভাষ্য নেই। বৃহত্তর সামাজিকতা থেকে এক নিবিড় এবং নির্জন জীবন উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। শ্রাবণের এক আচ্ছন্ন দুয়ার খুলে দিয়ে তিনি কেবল অপেক্ষায় থাকেন। বদলে যাওয়া দৃশ্যপটের বিরহ তার কবিতার এক মৌলিক সুর। কত টুকরো টুকরো কথায় তিনি এক সহজ লোকায়ত জীবনের দৃশ্যকার হয়ে ওঠেন। এইসব কবিতার একটি নিজস্ব জীবন দর্শন আছে। তা নির্জন এবং গভীর।শান্ত এবং নিবিড়। কত গোপন গান শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ে পাঠকের দুয়ারে। পঙ্কজের বইটি জুড়ে আমরা শুনতে পাই নৈঃশব্দ্যের আলাপ। গহীন আকাশ আর জলের সিঁড়ির নির্জন কথকতা। কত সহজ ভাবুকতায় তিনি আমাদের মনে গেঁথে দেন স্মরণীয় কিছু পঙক্তি। যেন শব্দ জুড়ে এক মায়াবী আচমন।

"মানুষ বড়জোর দু-পা হাঁটে

দু-পায়ের বেশি হাঁটলে

সে মানুষ ক্রমশ পথ হয়ে যায়..."

 কিংবা,

 তোমাদের উৎসবের ঝিল্লিরব থেকে দূরে

যে রাত্রি ডুবে আছে নিজস্ব কালোর গভীরে

তাঁর ধ্যানে ধানের বুকে দুধ জমে ওঠে।

মগ্নরাত ও একমুঠো ভাত জানে

উঠোনের হাহাকার কখনো সিম্ফনি হবে না। "

 পঙ্কজের কবিতার একদিকে যদি থাকে প্রকৃতি, অন্যদিকে আছে পরিবার। ছোটো ছোটো সম্পর্ক। মৃদু স্মৃতির প্রেম। বৃক্ষমর্মরের অনুবাদ তাঁর কবিতা। তিনি জানেন 'শরীরের বিবাহ হলে পুড়ে যায় সকল আসবাব।' ইচ্ছের গভীরে পানকৌড়ি মেলে দেয় ডানা। সমস্ত জীবনব্যাপী অনুভবে তিনি বুঝতে পারেন 'চুরাশি লক্ষ যোনি পেরিয়ে এলে/সমস্ত জাতককথা মা শব্দে আকুল হয়ে ওঠে।' পঙ্কজ তাঁর কবিতায় মাকে কেন্দ্র করে উচাটন অনুচ্চারিত সংসারের ছবি আঁকেন - 

 "মা আমার দাওয়ায় বসে ভাবনা সেলাই করে

বাবা ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করেন অভিমান

আমি ছেঁড়া পালক হাতে

অনুবাদ করি যাবতীয় অন্ধকার

 

অন্ধকারের শরীরে কোনো যতিচিহ্ন নেই।"

 আমি এই কাব্যগ্রন্থ জুড়ে যে কবিকে দেখি তিনি যেন বিভূতিভূষণের সন্তান। এক তুচ্ছ জীবনের কথাকার এবং কবি পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন,পেরোচ্ছেন সুদূরের পথ। আমরা মুখোমুখি হতে চাই এই বইয়ের শেষ কবিতাটি নিয়ে। পঙ্কজ লিখছেন - 

 "নিজের ভিতরে এক সকাল রেখেছি

মা এসে রোজ ডাকে 

                                     ওঠ

সারাদিন যত পথ হাঁটি

মনে হয় পথ নয়,

মা এসে বিছিয়েছে শাড়ির আঁচল।"

 আমরা ফিরে যেতে চাই কয়েক দশক। বিভূতিভূষণের একটি গল্পে।'প্রত্যাবর্তন' এই শিরোনামে বিভূতিভূষণের দুটি গল্প আছে। একটি গল্পে দেখি কাকিমার নির্দয় আচরণ সহ্য করতে না পেরে গোবিন্দ নিজের গ্রামে মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। আরেকটি গল্পে জীবন আরও নিষ্ঠুর। বাসগৃহে, বন্ধুমহলে সকলক্ষেত্রে উপেক্ষিত বিনোদ নিদারুণ অসুস্থতা নিয়ে বাড়ি ফেরার পণ করে। কিন্তু পথ শেষ হয়না। অসুস্থ বিনোদ ক্লান্ত, পথের ধারে বসে ভাবে :

 'হঠাৎ আমার মনে হোল ওই আমতলাতেই মা আঁচল বিছিয়ে বসে আছেন। আমি আসবো বলেই কখন থেকে বসে আছেন। মা এগিয়ে এসেছেন আমায় নিতে।'

 শালুক ফুলের মতো একজন কবির সামান্য জীবন ধরে আছে এই বই। শিল্প এবং জীবন দুদিক থেকেই তার সফলতা। কবির প্রথম বইয়ের কোনো দুর্বলতা নেই। বাংলাসাহিত্যে অসামান্য প্রথম কাব্যগ্রন্থের যে উত্তরাধিকার আছে এই বই তার এক উজ্জ্বল সংযোজন। হয়তো সারাজীবন এই গ্রন্থের ছায়া তাঁকে অনুসরণ করবে যেকোনো বাঁকের মুখে।

Comments