বিদুর।। চৈত্রে, গৌরীপুর: তথাগত।। পাঠ- প্রতিক্রিয়া: রাকা দাশগুপ্ত।।


"চৈত্রে, গৌরীপুর", একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
                                      — রাকা দাশগুপ্ত 
"এমন ভিখারী আমি কখনও লিখিনি" 

তথাগতর "চৈত্রে, গৌরীপুর" বইটির মূল সুর বাঁধা হয়ে যায় যখন দেখি উৎসর্গপত্রে লেখা আছে "মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র প্রাতঃস্মরণীয়েসু"। বুঝতে পারি, বাংলার আবহমানের আলো-হাওয়া এই কবিতাগুলির অন্যতম উপাদান। আর আছে চৈত্র-ঋতু , এ-কাহিনির নায়ক সে-ই। কবিতাগুলির নামও অনুরূপ - "চৈত্রে, গৌরীপুর", "চৈত্রে, শেষ রৌদ্রমালা", "বসন্তে, উৎসবে"। 

চৈত্র কেন? ভাবি, এই ঋতুটির রং বোধহয় কিছু আলাদা। বসন্তই, কিন্তু ফাল্গুনের অপরিণত উচ্ছ্বাসের বসন্ত নয়।  ফাল্গুন যদি আবীররঙা হয়ে থাকে, চৈত্র তবে গৈরিক... সর্বাঙ্গে বৈরাগ্য মেখে ধুলো-পায়ে খরবৈশাখের দিকে যাত্রা তার। 

তথাগতর কবিতা পড়া যাক? 

" পানপাত্রে মুখ দেখি। কপালের ছায়া পড়ে। দেখি পশুর আর্তনাদ নিয়ে সকাল গড়ায়। হাওয়ার স্বনন শুনি চৈত্রদুপুরময়। বিকেল এসেছে যেন ঝড়ে পড়া ঋজু শালগাছ। 
বেদনার ঘুড়ি তার শাখালগ্ন, মেঘে মেঘে লাট খেয়ে পড়ে আছে সকরুণ। 

বাদী ও বিবাদী স্বরগুলিও , সুতনুকা, এই পানপাত্র সকলই দেখায় 
শুধু দূরে আমাদের দেশঘর, সদাশিব বরটি তোমার,
অপার চৈত্রে কোনো ফসল ছিল না তাই ভিক্ষায় চলে যাবে ভোলা 
-সেই ভবিষ্য দেখায় না।" 

"চৈত্রে, গৌরীপুর" কবিতার চতুর্থ অংশ। 

পানপাত্রে মুখ দেখা। পাত্রের জলতলে  ভেসে ওঠা বিম্বের কথাই হচ্ছে, নিশ্চিত। তবু, শব্দযোজনার গুণে কেন যেন অন্য এক "পান" ও চকিতে উঁকি দিয়ে যায়... কারও পানের পাতার মত মুখশ্রীর ছায়া পড়ে কি সেই জলে? দুপুরের পানের বাটার গন্ধ আসে কি? শব্দ থেকে শব্দে দুপুর গড়িয়ে যায়।  "ঝড়ে পড়া ঋজু শালগাছ" - বিকেলের অভিধা  হয়ে আসে। 

এ এক অন্যরকম চৈত্রযাপন। রুক্ষ,  ব্যথাদীর্ণ। গাজনের কথা মনে পড়ে যায় অবধারিতভাবে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখি, শিবের অনুষঙ্গেই ফিরেছে কবিতাটি - "ফসল ছিল না তাই ভিক্ষায় চলে যাবে ভোলা"। বস্তুত এই বইটির অন্য অনেক কবিতাতেও এমনভাবে উঠে এসেছে শিবের উল্লেখ—

"জ্বরে পড়ে আছে ভোলানাথ আর গৌরী এসে গ্রাস তুলে দিচ্ছে মুখে 

পুরাণবাগীশের কাছে এ সংবাদ মিথ্যে, অর্বাচীন 

ইতিহাসবিদকে বোলো না এই তুচ্ছ, অস্তিত্বহীন কথা 

কবিকে জানিয়ো। আত্মহত্যার কথা মনে আনলেই
সে তোমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে ক্যান্সার হাসপাতালে,  বিকেলের বাগানে" 

অথবা 

"কতকাল খাওনি তুমি, কতকাল দূরে আছ— গৌরীপুর, তোমাদের দেশ-ঘর ।
একহাতে টিনের বল্লম আর সস্ত জটাজুটে তুমি নয়নমোহন ভোলা" । 

"চৈত্রে, শেষ রৌদ্রমালা", "চৈত্রে, শেষ রৌদ্রমালার শেষ কবিতা" র ভঙ্গিটি আবার অন্য। এখানে, কথার তোড়ে এসেছে কথা, বাক্যগঠন ভেঙেচুরে গড়িয়ে গেছে পংক্তি থেকে পংক্তিতে। প্রথম অংশের কবিতা যদি হয় সন্ন্যাসী শিবের ঔদাস্য, দ্বিতীয় অংশের কবিতায় তবে তাঁর রুদ্রতাণ্ডবের আভাস— কালবৈশাখীতে উড়ে যাওয়া শুকনো পাতা যেন! সেই স্রোতের মধ্যে থেকে তুলে আনছি কিছু অমোঘ শব্দবিন্যাস—

“ চতুর্দোলা এই হাওয়া। এ হাওয়া শববাহকের পায়ে পায়ে খইয়ের নুপূর",

 “ এমনকি ঈশ্বর, দর্শনে জেনেছি যাকে, সেও তত ফলিত ও স্পর্শময় স্পর্শময় স্পর্শময় নয়" 

"তথাগত সেই, নগরের পথে যার ছায়া পড়ে ছিল সন্ধ্যায়, অধোমুখ, প্রাসাদের চেয়ে উঁচু" 

নতমুখ একটি ছায়াও যে "প্রাসাদের থেকে উঁচু" হতে পারে, এ বোধ  তো আসলে বৈরাগ্যেরই এক রূপভেদ;  যার সঙ্গে চৈত্রের ধুলো ওড়া রাঢ়বাংলার পথটি  ঠিক মিশে যায়। 


"এবার, সমুদ্ররচনার ভূমিকা " 

যে-কোনও কবিতাপাঠের প্রথম ঘোর, প্রথম মুগ্ধতা পেরোলে তারপর প্রকরণের দিকে চোখ যায়। এই বইতে দেখি, শব্দচয়ন আর শব্দবিন্যাসের মধ্যে একটা আপাত-অবিন্যস্ত ভঙ্গি— ঘোর কথ্যভাষার পিঠেই  আচমকা সওয়ার হচ্ছে সুললিত তৎসম শব্দেরা, বা, চলিত রীতির বাক্যবিন্যাসের মধ্যে গুপ্তঘাতকের মত ঢুকে পড়ছে একটু দু'টি সাধু ক্রিয়াপদ। তাতে তাল কাটছে না কোথাও।  বরং মনে হচ্ছে কবি একটা খুব বড় রঙেবাক্স নিয়ে আঁকতে বসেছেন। যখন শব্দের যে বিশেষ শেডটি দরকার, ছুঁৎমার্গহীনভাবে নির্দ্বিধায় সেটা তুলে নিচ্ছেন, কারণ এক চিরকালীন বাংলাভাষাই তাঁর রঙ তুলি ও ক্যানভাস। 

যেরকম,

“ সরকারি জলার ধারে জোড়া ইউক্যালিপটাস এ ওর ঘাড়ে কন্ডূয়ন
করে খস খস ধ্বনি হয় এই তিনমাস হল্ট স্টেশনের গায়ে নির্জন বাঁশের বেঞ্চি
আর পথের পবনে আর পথের ধুলোতে নিদারুণ ঘূর্ণি লাগা ঘোর

আর 

এই তিনমাস তুমি এই পবিত্র শরীরকে, প্রভু, শরীর পবিত্রতম, দাও, প্রার্থনা করি" 


এই যে পর পর বাক্যে ইউক্যালিপটাস, হল্ট স্টেশনের পাশেই "পথের পবন" বসে গেল অনায়াসে, বা যতিচিহ্নহীন তিন লাইনের গড়িয়ে যাওয়ার পর শেষ পংক্তির এই অদ্ভুত গঠনে থামল কবিতা, তা এই ক্যানভাসের বিস্তারেরই ইঙ্গিত দেয়। 

এমনই আরও কিছু পংক্তি— 

"পৃথিবীর তাবৎ মেয়েমাগিদের এই নিবিড় নিবিড় নিবিড় সুরলহরীর থেকে 
আমাকে চাবকে নিয়ে চলো মহাকাল মন্দিরে। 
তার পাষাণে পাষাণে আমি অন্ধপথচারী হয়ে ছুঁয়ে দেখব আর ঘ্রাণ নেব আর 
কষ্টিপাথরের স্তনে কনকরেখা হয়ে যাব আমি, ওগো কালো হাওয়া" 


এখানেও, অতি-সাধারণ কিছু শব্দ থেকে উড়াল শুরু করে যে বিন্দুতে উত্তীর্ণ হয় কবিতাটি, তার তুলনা নেই। মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ পীনপয়োধরা যক্ষিণী আর স্পর্শাতুর অন্ধ পথিকের দৃশ্যে   গিয়ে থমকে দাঁড়ায় সে, আর সংক্ষিপ্ত বিদ্যুচ্চমকের মত পড়ে থাকে 
" কষ্টিপাথরের স্তনে কনকরেখা" র উপমাটি। 

এও মনে হয়, কবি বেশ সাহসী। কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে " সুরলহরী" বা "পথের পবন"-এর মত অ-সংকোচ "লিরিকাল" ও প্রাচীন শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে বুকের পাটা লাগে বৈকি! দুর্বলতর কবিতা, যার নিজেকে গায়ের জোরে সবল ও আধুনিক প্রতিপন্ন করার দায় থাকে, তার  পক্ষে এ সাহস দেখানো সম্ভব নয়। একমাত্র যে কবিতা নিজের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত;  এবং নিশ্চিত যে যে-কোনো শব্দরীতি, বাক্যরীতিকে আ-মূল  শুষে নিয়ে সালোকসংশ্লেষ ঘটানোর ক্ষমতা তার আছে, সেই কবিতাই হাঁটতে পারে এ-রাস্তায়। 

কবিতাগুলির মধ্যে বিচরণ করতে করতে দু'ধরণের মিশ্রণ-প্রক্রিয়া টের পাই। প্রথমত , যেটা আগে বলছিলাম, এখানে নিতান্ত প্রাকৃত ও লঘুভার শব্দের পাশে অনায়াসে বসে গেছে ধ্রুপদী শব্দমালা। দ্বিতীয়ত, কখনও কৌতুক কখনও তীর্যক শ্লেষ মিশে যাচ্ছে চলনে, আবার পরমুহূর্তেই হয়তো বদলে যাচ্ছে গাম্ভীর্যমন্ডিত মহাকাব্যিক কথনপ্রক্রিয়ায় । স্বরের এই বাঁকবদল ঘটছে বারংবার, এবং আশ্চর্য দ্রুততায়। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো নগরপথের জ্যামিতির মত সমকৌণিক নয়, বরং নদীবাঁকের মত মসৃণ, পেলব। 

৩ 
"কোন শিরীষের নীচে ঘোড়া তার আজও বাঁধা" 

দেড় ফর্মার ক্ষুদ্রাকৃতি বই "চৈত্রে, গৌরীপুর"। অল্প কয়েকটি কবিতায় বোনা এক নিটোল পৃথিবী। 

আগেই বলেছি, এ বই আবহমান বাংলাভাষার প্রতি  উৎসর্গীকৃত। শুধু মুকুন্দরাম বা ভারতচন্দ্র নয়, অন্য পূর্বসূরীদের প্রতিও  পরোক্ষ ঋণস্বীকার ছড়িয়ে আছে  ইতস্তত। বইটির  নামকরণ যেমন অবধারিতভাবে মনে পড়ায় উৎপলকুমার বসুর "চৈত্রে রচিত কবিতা"কে , বা " চৈত্রে শেষ রৌদ্রমালার শেষ কবিতা" নামটি মনে পড়ায় উৎপলেরই "পুরী সিরিজের শেষ কবিতা"কে। সেইরকমই, নীচের  লাইনগুলো যদি পড়ি -

“ হে অনির্বচনীয় প্রেমিকারা, হাওয়ায় উবে যাও, হুণ্ডির  সুধাসাগরে নিজে ডুবে মরো ... “ 

একই বাক্যে "অনির্বচনীয়" আর "হুণ্ডি"র উপস্থিতি নির্ভুলভাবে মনে আনে না কি জীবনানন্দের "পৃথিবীতে সুদ খাটে : সকলের জন্য নয়/ অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু-জনের হাতে" ? 

মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতার যাত্রাপথ দু'রকমের হয়। এক, যে-কবিতা বিস্তীর্ণ বহির্পৃথিবীর থেকে উপাদান আহরণ করে নিয়ে খুব ব্যক্তিগত পরিসরের বিন্দুতে  এসে শেষ হয়, অভিসারী আলোকরশ্মির মত।  দুই, যে-কবিতা ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে ডালপালা মেলে দেয় বাইরের আকাশে, যেন অপসারী রশ্মিগুচ্ছ। 

এই বইতে তথাগতর কবিতা সম্ভবত এই দ্বিতীয় গোত্রের। কারণ, নিজস্ব কিছু অনুষঙ্গ নিয়ে শুরু হয়েও  কবিতাগুলি  নিজের দৈনন্দিনের  পরিসরটুকুকে অতিক্রম করে গেছে—  ব্যক্তিগত সংলাপ ক্রমশ ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজনীনে। হয়তো এ প্রত্যাশিতই, কারণ যে কবিতায় চৈত্রের ধূলিমলিন  বৈরাগ্যের সুর, তা যে শুধু গৃহকোণে আবদ্ধ থাকবে না সে তো বলাই বাহুল্য।  হল্ট স্টেশন , হাড়কাটার চামেলি কিংবা ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে কবিতারা তাই  এ বইতে ডানা মেলে  উড়ে গেছে যক্ষিণী ও অন্ধ পথিকের কাহিনিতে, মুণ্ডিতমস্তক তথাগতর দীর্ঘ ছায়ায়, "জন্ম ও অজন্মের মাঝখানে একফালি তুলো ওড়া হঠাৎ বিকেল"-এ।  
" চৈত্রে, শেষ রৌদ্রমালার শেষ কবিতা"  থেকে উদ্ধৃত করি, এই প্রসঙ্গে? 

"এই পথ এই মোহ এই সন্তাপ
এই অপরাপর জয় পরাজয় মন্দির মসজিদ মসনদ সব বুকে লিখে রাখি। 
এ পৃথিবীতে মানুষের বংশবৃদ্ধি হবে ; মানুষে মানুষে এই আকাশ পাতাল 
অন্তরীক্ষ মহাফেজখানা পূর্ণ হয়ে যাবে। তারপর একদিন মানুষের পচা
মাংস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে এই সভ্যতা তার বিজ্ঞান কুশলতায় আরও
সব মহাজাগতিক প্রাণীর চেয়ে সর্বশক্তিমান প্রতিপন্ন হবে—
এসো, এইসব ভবিষ্যকথা বুকে লিখে রাখি।" 


ব্যক্তিগত চৈত্রের ধুলোপথটুকু এই যে প্রসারিত হয়ে গেল মানুষের অনাদি-অনন্ত যাত্রায়, তার খতিয়ানটুকু লিপিবদ্ধ হয়ে রইল এক আশ্চর্য নির্লিপ্তিতে, এ জন্যই এই বইটির কাছে বার বার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। 

Comments