বিদুর ব্লগজিন।। রণজিৎ অধিকারী-র গুচ্ছ কবিতা।।

 


রণজিৎ অধিকারী-র পাঁচটি কবিতা 


সময়  

 এই যে... এই আঘাত আমার

...  জায়গাটা চিহ্নিত করে রাখা যায় না!

আঘাত পাওয়াটা শুধু,

স্থান— সমুদ্র থেকে কিছুটা উঠে এসে... হ্যাঁ,

এই তো যেখানটায় বুধবারের আধখাওয়া রক্তমুখ,

বুকের সামান্য নিচে ; সাক্ষী— লম্বা দাঁড়ির মতো

                    ছাল ওঠা ওই সাদা য়্যুক্যালিপটাস।

                          

আমাকে সেই চিহ্নগুলো দেওয়া হয়েছে— তুমি দূর থেকে

যাতে সহজেই  চিনে নিতে পারো।

কিন্তু কাছে এলে চিনতে পারবে— এমন কী আছে?

যখনই কাছে আসো, তুমি দেখতে ভুলে যাও আমাকে,

তোমার চোখ শূন্যের দিকে তাক করা— স্থিরনিবদ্ধ।

তবু এই সময়টাই ভালোবাসা, বুঝতে পারি ... যখন

আমার ক্ষতস্থানটায় তোমার জিভ বোলাতে থাকো... 

আ... মি... আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, আমি এই...

এই ভালোবাসার সময়টাকে চিহ্নিত করতে পারি না!

 

 আলো

 তোমার নগ্নতার কাছে গিয়ে দেখি,

সমুদ্রের খাঁড়িগুলোকেই এনে রেখেছ তোমার ও-শরীরে

 —যেন কোনো জেনবাদীর ধ্যানে বসবার মতো

অনুচ্চ দুই টিলা কিন্তু ধ্যানমগ্ন হওয়ার সময় এ নয়।

সবকিছু ভুলে আমাদের আত্মাগুলোকে খুলে রাখি

আর উপগত হই।

আশ্লেষে তুমি যে সাড়া দাও— তা যেন

কোন্ অন্যজন্মের দূর অতীত থেকে!

আমি যতই খাদের দিকে নামি ততই আলোয়

ভরে উঠতে থাকে খনির শরীর আর তুমি ...

তুমি যখন উপরে উঠে আসো, ঠিক তখনই

একটা ঊর্ধ্বমুখী ঝলমলে স্রোতের জন্ম হতে থাকে।

.  .  .

কিন্তু আমরা যখন থেমে যাই

ঈষদুষ্ণ বিছানা কাঁপতে থাকে পাতের মতো

আর আমরা ফের খুঁজে নিতে থাকি অন্ধ অঙ্গগুলো,

হৃদয় আর আত্মা।

তারও কিছু পরে যখন তুমি আলো জ্বেলে দাও

তখনই কেবল আমরা অবসন্ন বাস্তবতায় ফিরে আসি।

 

 দাগ

 তুমি যখন দেখছিলে আমাকে,

আমি তখন সময়টাকেই খুঁজছিলাম।

ইচ্ছে হয় পেনসিলে একটা দাগ দিয়ে রাখি।

 

যেমন খাঁ খাঁ বুকের সেইসব আকাশগুলো, তোমার

বিকেলের পায়ের কাছে পড়ে থাকা বিষণ্ণ পাতা, আর

একে একে যারা তোমার শূন্য বুক ভরিয়ে দিতে এসেছিল

                              তাদের বিচিত্র ভঙ্গিগুলো ...

সময়ের ভেতর অটুট হয়ে আছে আজও!

 

স্তব্ধতা মানে কি সময়েরও স্তব্ধ হয়ে থাকা?

 

তুমি যখন স্পর্শ করছিলে আমাকে,

সময়টাকেই খুঁজছিলাম আমি— যার একটা দিক

                                                   করাতের মতো!

তুমি ভালোবাসছিলে আর আমি তখন চাইছিলাম

অন্তত একটা ঘষটানোর দাগ থাকুক।

 

 নোঙর 

 তোমার মুড়ে রাখা দু'হাঁটুর ওপর আমার দু'হাতের তালু  দিয়ে

বোলাতে থাকি, আঁকড়ে ধরি আঙুলগুলো দিয়ে।

একটা কুঁচকে যাওয়া অগোছালো বিছানায় আমরা

কখনো ভেসে উঠছি, কখনো তলিয়ে যেতে যেতেও

আবার ফিরে আসছি।

কিন্তু কখনোই আমরা সম্পূর্ণ তলিয়ে যাই না,

কখনোই সবশুদ্ধ ভেসে উঠতে পারি না।

একেকটা আচমকা ঢেউ আসে আর আমরা যেন

তীব্র মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসি।

তখন আমাদের চাপা স্বরে বলা কথাগুলো বাইরের

শ্রাবণ রাত্রির গোঙানির সঙ্গে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।

 

কিন্তু নোঙরগুলো —যারা তাদের অঙ্কুশ ও অদৃশ্য

দড়িদড়া সমেত প্রোথিত থাকে অন্য একটা জগতে ;

যখন আমরা আশ্লেষে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছি

তখনও হাল ছাড়ে না তারা।

এ জগৎ থেকে কখনোই দেখা যায় না তাদের,

অথচ আসন বদলে নেওয়ার সময় কিংবা ঢেউয়ের পর ঢেউ

 যখন আছড়ে পড়তে থাকে বিছানায়, তখনও

তাদের উপস্থিতি আমরা দুজনেই টের পাই।

 

 পথ 

 মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারি এই গাছপালা সমুদ্র পাখির

বাইরে কোথাও একটা দুর্জ্ঞেয় অর্থ আছে,

                                                     একটা কোনো রূপ।

 

কিন্তু বাইরে দিয়ে কোনো পথ নেই।

এই পাতার শিরাগুচ্ছ, রোদের টুকরো, তোমার চোখ,

... তোমার যোনি ...

এসবের ভেতর দিয়েই আমাকে যেতে হবে।

 

আমার আয়ত্তে থাকা ঢেউগুলো কিংবা

হাওয়ারা পাতার সঙ্গে যখন কথা বলেই চলে

কিন্তু তারা কী বলে!

কখনোই বুঝে উঠিনি

এই খাঁড়িগুলো বানানোর অর্থ,

তোমার নাভির নিচের সুডৌল ...

 

কিন্তু আমাকে তো এইসব পথ দিয়েই যেতে হবে 

 

 

 

 

 

 

Comments