বিদুর ব্লগজিন।। সৌভিক গুহসরকার-এর গুচ্ছ কবিতা।।
সৌভিক গুহসরকার-এর গুচ্ছ কবিতা
বাজারকৌমুদী
১
মৎসদর্শন
মাছের দাম বেড়ে গেলে, বিষণ্ণ হয় আমাদের মাছখেকো পকেটের দাঁত
বেদনায় ভিজে ল্যাতপ্যাত করে টাকার ক্রয়ক্ষমতা। কেন বাড়ল দাম? মুড়ো বেড়ে গেল? ল্যাজা বেড়ে গেল? মাছ কি কবি হ’ল শেষে? সে কি চাঁদের আলোয় শব্দ ধরতে শিখেছে?
কিছুই নয়। মাছ মাছই আছে, তবু দাম বেড়ে গেল। জালে ওজনের মাছ ওঠেনি ব’লে, দামের ওজন বেড়ে গেল।
বাজারের নালন্দায় শীলভদ্রের মতো ঘুরে তার পুঁথিপত্র বুঝতে চাই। বুঝতে চাই বাজারের চর্যাপদের ভাষা। দামের ডালপালা দেখি, তার শেকড় কোথায়?
প্রাতিষ্ঠানিক ইলিশের পাশে ভূমিপুত্র ট্যাঙরা― সেই দুই কবির কবিতাসমগ্ৰের মতো― যে কবিরা জীবদ্দশায় পরস্পরকে গালি দিয়েছে বিস্তর; অথচ মৃত্যুর পরে তাদের বইয়েরা কালের বঁটির সমুখে সুশান্ত সৌম্যকান্ত পাশাপাশি― যেন ভাই, যেন শব্দবন্ধু
সবই যখন কেটে কুটে তুলে দিতে হবে ক্ষুধায়, তখন আঘাত করে কতদূর যাওয়া যাবে? অপরের লেখা আটকে কতখানি প্রতিভা লাভ হবে? কতটা প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে অন্যের লেখাকে অযোগ্য প্রমাণ করে? নিজের থেকে যাওয়া নিশ্চিত হয় কি? কেউ থাকবে না, আমি থাকব শুধু—এতটাও কি ভাবা যায়?
একটি লোকপ্রিয় কাতলা মাছের বৃহৎ মুড়ো ব্যথায় লন্ঠন জ্বেলে হাঁ করে থাকে― কী যেন বলতে চায়― বড্ড বেশি কবিতা লেখা হয়ে গেছে তার― বহু বেনোজল―?
যে বেচবে সে জানবে না, যে কিনবে সে বুঝবে না
২
বেড়ালপুরাণ
বাজারে বেড়ালের চাহিদা নেই, তবু বাজারে বেড়াল
মাছপুরুষের টাটকা ঘ্রাণে বেহায়া ঘাঘু মেয়েমানুষের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে আসে। একটা মুড়োর ছাঁট, খয়েরী কানকোর মাংস, ছিটকে ওঠা রক্তমাখা গাদার টুকরো মিলবে না?
বেড়াল এ কথা জানে বিলক্ষণ― পয়সা নেই তার, তবু খাদ্য চাই। এ পৃথিবীতে সবাই সমান নয়, তাও সবার বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে নিজের মতো।
বাজারের থলি নেই, শুধু পাকস্থলী আছে; ভরতে হবে, না হলে মরতে হবে। তাই থাবায় সে বাঘ; অপেক্ষায় মহর্ষি; সতর্কতায় জঙ্গি।
যেবার দোকানির গামলা থেকে একটি কই মাছ ঘুড়ির মতো লটকে গেল মাটিতে, সেবার আলোর মতো ক্ষিপ্রতায় নক্ষত্রে লাফিয়েছিল সে― তার থাবায় জবা―
সমস্ত বাজারস্বর্গ কেঁপে উঠেছিল। পৌরাণিক দেবতারা বঁটি হাতে তাকিয়েছিলেন নির্নিমেষ। কী হয়, কী হয়!
অবশেষে কইমাছ বধ ক’রে, তাকে দাঁতে গেঁথে সে দৌড়ে গেল পতিতপাবনী পুণ্য নর্দমার তীরে― তার অভুক্ত লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিকের কাছে
৩
ডিমের দোকান
হলুদ বালবের আলোয় বোঝা যায় ডিমের স্বরূপ
সবুজ কাঠ আর জালের সঙ্ঘারামে নিবিষ্ট শ্রমণের মতো ডিমের দল জপ করছে ত্রিশরণমন্ত্র। পেরেক থেকে উড়ছে কোনও এক লক্ষ্মীভাণ্ডারের ক্যালেন্ডার। পেঁচার মুখটি লাজুক রাজনীতিবিদের মতো।
দিশি মুগরির ডিম যেন বাউল। আলোক সাধনায় মৌন। টেবিল ফ্যানে উড়ছে ডিমের গায়ে লেগে থাকা পালক— ভাসছে খোপক্রেটের মৃদু কাগুজে ঘ্রাণ। দু’একটি খবরকাগজের ঠোঙাও পাখির মতো উড়তে গিয়ে শেষে আরশোলা ও হতাশার মতো আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছে।
ডিমের চেয়ে নিরীহ কে? আঁশ নেই, কাঁটা নেই, হাড় নেই। ডিম পবিত্র সাধক। তপস্যায় তার কলেবর সূক্ষ্ম, ভঙ্গুর ও পদ্মকোরকের মতো নিটোল। জীবনের সর্বোত্তম কুসুম ধারণ ক’রে সে মৌন। সে পেয়েছে, তাই চুপ করে গ্যাছে। লাফিয়ে ঝাপিয়ে কিছু প্রমাণ করার নেই।
তবু তাদের গায়ে ব্যথা দিলে, তারা চোখ খুলে তাকায় একবার― ভেঙে যায়, মোক্ষ লাভ করে; এটাই প্রতিবাদ, এটাই প্রতিরোধ, এটাই বিপ্লব। তারা জানে, ডিম নষ্ট হলে, পাখিটিও জন্মাবে না আর। চাকা ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তাই তাদের তোয়াজ ক’রে রাখা।
সাধনবাবুর দোকানে ভিড় দেখে অন্য একটি ডিমের দোকানে গেলুম। বাজারের এক কোনায়। নতুন দোকান? দোকানির মুখ গামছায় ঢাকা। ‘এক ডজন ডিম দিন তো’― বলাতে সে তাক খুলে দেখাল শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি বুধ
চারপাশে তাকাই― দেখি বাজারে গড়িয়ে যায় অগণিত অশ্বিনী ভরণী মৃগশিরা রেবতীর দুধ
৪
ঝিঙেপাখি
ঠ’কে যাওয়া ঠিক কতটা পরাজয়?
অথচ বাজারে গিয়ে না-ঠ’কে ফেরে না কেউ। যদি এটা হার হয়ে থাকে, তবে এ জীবনে হেরেছি অগণন। কুমড়োর মাংসে পচন ছিল―বুঝিনি; পটলের কলেবর বৃদ্ধ হয়েছিল―বুঝিনি― বাড়ি ফিরে দেখে বুঝে হেরে গেছি গোহারান।
অথচ বিশ্বাসে ভুল ছিল না― অথচ ষোলোআনা ভদ্রতাও ছিল― অথচ সহজ ছিল টাকা বিনিময়― তবু হেরে গেছি― রথের চাকার মতো থলি ডুবে গেল বাজারের সুচতুর ক্লেদে।
কে কাকে হারায়? কতখানি রক্তমাখা যুদ্ধ থাকে একটি নিরীহ দরাদরির ভেতর? আমি তো শত্রুর দেশ থেকে আসি নি, তবু পরাজিত করলে? আমি তো অস্ত্র নিয়ে আসি নি, তবু এতখানি পরাজয়?
ঠ’কে যাওয়া অপরাধ? তবে কি বিশ্বাস করা আরও বড় পাপ? তবে কি তলোয়ার ঘোরাতে হবে প্রতিটি কথার ভেতরে? তবে কি এ জীবনে জয় ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই? জিততেই হবে? যদি না জিতি, যদি হেরে যাই বারবার― তবে? এত পরাজয় কোথায় রাখি―
গভীর রাতে আমাদের করুণ বিশ্বাস থেকে উড়ে যায় ডানাপচা অন্ধ ঝিঙেপাখি
৫
জবুবাবুর বাজার
কাত-করা ঘন তমসায় বাজার বসে; গুড়ের বাতাসার মতো লন্ঠনের আলোয় এঁদো গ্ৰাম বিক্রি হয় জলের দরে জবু চার্ণকের পালতোলা হাতে। কোম্পানির গামলায় চারাপোনার মতো খাবি খায় হাবিজাবি দিশি মানুষেরা। মোগল দোকানদার আঙরাখা বেচে দেয়; তারপর পাতলুন; তারপর দেশ ...
বাজারে রেড়ির তেলের কুপি জ্বলে। ফিরিঙ্গিদের মুখ চকচক করে জগৎশেঠের সিক্কার মতো। ডিমের দোকানের তাকে রাখা মহারাজা নন্দকুমারের টাটকা মুণ্ডু। সবজির বাজারে কুমড়োর খোলায় আফিম, পটলের পেটে তুলো, নীলে ডোবানো ঢেঁড়স। ঘোর তমসায় বাজারে স্তব্ধলিঙ্গ কৃকলাশের সঙ্গে চিতায় চড়ে চতুর্দশীর বালিকাচাঁদ; হেজে যাওয়া ঢাক বাজে―খই ওড়ে―পুণ্য ফাটে―
চল্লিশ বছরের এক যুবক পাগড়ি পরে এসে অন্ধকারে একটা বাতাবিলেবু চেখে বলে, পচে গেছে এ বাজারের পুরাতন ফল― নতুন ফলের আমদানি করো। গুঞ্জন শুরু হয়। ফলওয়ালারা জুতো হাতে তেড়ে আসে। আকাশে ভোরের রেখা ফোটে― আলো?
চাদর পরা বেঁটে একটি লোক শাকপাতা তুলে ফেলে দেয়― কবেকার শাকপাতা, এখনও বিক্রি করছেন? টাটকা শস্য কোথায়? নতুন কৃষক তৈরি করব বলে খেত পেতেছি―বাজারের আমদানি পালটানো হোক। মোড়লগিরি-করা দিশি বেচারামের দল ক্ষেপে উঠে থুতু ছেটায়, ফিরিঙ্গিরা তামাশা দ্যাখে― ভোর কি তবে স্থির হল? আলো?
হঠাৎ বাজারে শোরগোল ওঠে— সবজিওলা বলে, পটল সত্য; ডিমওলা বলে— হাঁসের ডিমের চেয়ে উঁচু অবস্থা নেই আর; মাছওলা বলে, রুই মাছের চেয়ে বড় সাধক জন্মায় নি; কসাই বলে, মাংস পুজা করো। গ্রামের এক অশিক্ষিত পাগল পুরুত টলমল করে বলে, ওগো—গোলোকে গোল নেই, সব এক—পটলেও যে, পাঁঠাতেও সে— ভোর স্থির হয়। আলো।
উপলব্ধির কিনার থেকে কুয়াশা ভেঙে উড়ে যায় বকের ঝাঁক; জবুবাবুর বহুকালের বাজার এবার আলোদোতারা― সুরের ভেতর শালুক ছিটকে ওঠে!
Comments
Post a Comment