বিদুর।। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একাশিতম জন্মদিনে পঠিত গৌতম বসুর পাঠ প্রতিক্রিয়া।।
কবি গৌতম বসুর এই পাঠ প্রতিক্রিয়াটি গত ২ রা সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ শিশির মঞ্চে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর একাশিতম জন্মদিনে পঠিত হয়েছিল।
১। শ্লোক
পুণ্যবানেরা রচনা করেন সেইসব আশ্চর্য শ্লোক
যাঁর শোনেন, তাঁরাই ধন্য হন।
পুণ্য কুড়ানো আর পুণ্য বিলানো
দুটো ইচ্ছেই যৌবনে আমাদের চোখে রুমাল দিয়ে ঘোরাতো,
কিন্তু সেটাই ছিল আমাদের জীবনের সেরা সময়
[ ২০.০৮.৮৫ অফুরন্ত জীবনের মিছিল]
২। ঘোড়া
হাঁটে না সে, ওড়ে।
মাটিতে পা, কিন্তু তার সমস্ত শরীর
বাতাসের সঙ্গী। তার ডানা নেই
তবু তার চলায় পাখির গান।
সে ঘুমায় দাঁড়িয়ে, যেভাবে
পাখিরা ঘুমায়
[ ১৫.৫.৮৩ / শতভিষা ]
৩। আমায়
'কবিতা তুমি কেমন আছো?'
যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ,
অপমানে!
[ জুলাই ১৯৮১]
৪। সুখের দিনে মনে থাকে না
সুখের দিনে মনে থাকে না
দুঃখ তোমার কত আপন! তোমার বুকের
যা কিছু গোপন রক্তগোলাপ,
কে ফোটায়? — সে যে তোমার দুঃখ।
মনে থাকে না। তোমার নিজের কবিতা
তোমার মনে থাকে না
[ জুলাই ১৯৮০ / আরও এক আরম্ভের জন্য ১৯৮১]
৫। মাটি আমার মাটি
বলেছিলেন মহেশ্বর মাথায় হাhuত রেখে
'মাটিতে যাও! মাটির সঙ্গে জীবন মেলাও!'
সে
যেই দিয়েছে মাটিতে পা, পায়ে ঠেকল কঠিন শিলা
তাই নিয়ে সে মূর্তি গড়ল। দিন যায় রাত যায়
যেখানে মাটি, যেখানে পাথর! ...
'মাটি! আমার মাটি!
বল দেখি কী করি উপায়?— আমার ভূবন আমার হল না।'
হাতভর্তি পাথর
চোখের পাতা পাথর
বুকের রক্ত পাথর ...
তার মাটিতে পা, মাটির সঙ্গে জীবন মিলল না
[১৯৭৭ / বেঁচে থাকার কবিতা ১৯৭৮]
৬। অন্য মহাশ্বেতা
তোমার কলস ভর্তি জল ছিল ; কিন্তু আমি সেই জল স্পর্শও করিনি,
কেননা তোমার মুখে মানবীর লাবণ্য ছিল না।
আমার মহাশ্বেতা দেবী নয়, তার মুখের অমলতা স্পর্ধায় জ্বলে না
বরং সে করুণায় ম্লান!
তুমি সোনার কলস কাঁখে চলে যাও ...
আমি মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না।
[ ১৯৭৭/ দিবস রজনী কবিতা ]
৭। আর এক নদীর অনুভব
পাষাণে বুক রাখিস, কল্যাণী
শুনিস মত্ত বাঘিনী ডাকে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত
দেখিস জীবন-মরণ লড়াই রক্তমাখা পায়ের ছাপ ;
বুক জুড়ে তোর তবু তৃষ্ণার জল
নরখাদক পশুর রক্ত ধুয়ে
[ আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা / ১৯৭২]
৮। জল দাও
তোমার সঙ্গে অনন্তকাল ঝগড়া ছিল, সারা সকাল
চোখের আড়াল বুকের আড়াল
সারা দুপুর রৌদ্র শুধু মাথার উপর!
মাথার ভেতর টগবগিয়ে রক্ত গুলি
একশো ঘোড়ার পায়ের শব্দ,
পাহাড় পেলে গুঁড়িয়ে দেয় এমন ভীষণ!
তোমায় দেখলে সমস্ত মুখ ফেনায় ভাসতো
ঘোড়াগুলো থামতে গিয়ে সামনে পিছে ডাইনে বাঁয়ে
এ-ওর গায়ে চড় কষাত ; একশো ঘোড়া
মদ না খেয়ে সবাই মাতাল, মদ না খেয়েই, তোমার পাপে!
সেই সুবাদে ঝগড়া ছিল। ভর সন্ধ্যায়
তোমার গলার আঁচল ছিঁড়ে, তোমার হাতের প্রদীপ ভেঙে
তোমার প্রার্থনাকে আমার ইতর ভাষায় চৌদ্দপুরুষ
নরক করব, ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাদশাজাদা আমার হারামজাদা পরমেশ্বর
বুকের ভেতর, মাথার ভেতর, শিরা-উপশিরা রক্ত হৃদপিণ্ডের ভেতর কেটে
এলোপাথাড়ি চাবুক হাঁকায়! টলতে টলতে তোমার সামনে নতজানু
যন্ত্রণায় কোনো কথাই থাকে না, শুধু রক্ত ভাসে একটি শব্দ 'জল দাও! জল দাও'
[১৯৬৭]
৯। তের নদী জল
স্বপ্নে আমি দেখেছিলাম তাকে
মাটির সরায় আঁকা আমার মা
মাথার ওপর কোজাগরীর আলো
পায়ের পদ্মে জলের যন্ত্রণা
অসহ্য এক চেতনার উন্মাদ
আদেশ করল, ওঁকে প্রণাম কর!
আমি বললাম, ও-যে আমার মা
আমার এখন সারা অঙ্গে জ্বর।
কোলের উপর লুটিয়ে দিলাম মাথা
মা গো, কোথায় শান্তি কোথায় সুখ?
দেখিস নে তুই অনাহারে জ্বালা
চোখ চাইতে কাঁপে না তোর বুক?
স্বপ্ন ভাঙল ; তের নদীর জলে
বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে।।
১০। কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাদ ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখল
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে ; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে
[ ভিসা অফিসের সামনে / ১৯৬৭]
১১। ভুবনেশ্বরী যখন
ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে
একে একে তার রূপের অলংকার
খুলে ফেলে, আর গভীর রাত্রি নামে
তিন ভুবনকে ঢেকে ;
সে সময়ে আমি একলা দাঁড়িয়ে জলে
দেখি ভেসে যায় সৌরজগৎ, যায়
স্বর্গ -মর্ত্য -পাতাল নিরুদ্দেশে
দেখি আর ঘুম পায়।।
[ ১৯৬৪/ ভিসা অফিসের সামনে ১৯৬৭]
১২। বেহুলা
জলে ভাসছে ওফেলিয়া
জলে ভাসছে লখিন্দর
গাজন যেন ডাকাতের বিলে!
জলে ভাসছে ওলেফিয়া
জলে ভাসছে অবাক লখিন্দর
কন্যা! তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
[ ১৯৬৩/মুখে যদিও রক্ত ওঠে/১৯৬৪]
১৩। অনুভব
সমস্ত বিকেল, রোদ ধুয়ে দিয়ে বৃষ্টি চলে গেল
বিবর্ণ সন্ধ্যার মুখে নৈঃশব্দ্যির থরোথরো ঘোমটার আড়ালে
কাকের কান্নার মতো অনুভব করা যায়, কবে কাক
তাদের নাম ধরে ডেকেছিল বলে।।
[ জুলাই ১৯৫৮]
১৪। মুখ তোলো আমার প্রেমিক
চারদিকে কুয়াশা, আমি হৃদয়ের কান্নার তিমিরে
আর যেতে পারি না। আমি চেতনার মহানিশা ছিঁড়ে
ঘুমের স্বপ্নের মুখ আনতে পারলাম না, প্রেমিক
তুমি মুখ তোলো। অবচেতনার প্রেমে চতুর্দিক
আলো হোক। তোমার মুখশ্রী থেকে জ্বেলে নেব আনন্দ আমার।
কিন্তু মূর্তি নিরুত্তর, কালো পাথরের অন্ধকার।।
[ জাতক / ১৯৫৮]
১৫। সময় ঝরিয়া পড়ে
সময় ঝরিয়া পড়ে নির্জন দুপুরে
যেখানে বসিয়াছিলে একদিন মুখোমুখি,
তোমার চুলের গন্ধ বাসি হয়ে ধুলো হয়ে উড়ে
ক্লান্ত ক'রে দিয়ে যায় যেখানে সূর্যের গান,
তোমার আমার সেই ছোটো চিলে ঘরে।
সময় ঝরিয়া পড়ে শব্দ তার শুনি
আগমনে স্মৃতি থেকে চুমুগুলি তুলে এনে গুনি
কত তারা? ...তারপর সব গোনা হয়ে গেলে
চোখ মেলে আবার তাকাই ;
সময় ঝরিয়া পড়ে, শূন্য ঘর, কাছাকাছি কোনো ঠোঁট
কোনো চোখ নাই।
[ লখিন্দর / ১৯৫৬]
১৬। প্রভাস
স্মৃতির বালুচরে মুখেরা ভিড় করে
কেন যে ভিড় করে? আমি তো ক্লান্ত ...
এখানে নদীপারে গোধূলি গান ধরে
আকাশ নীলে নীল ; হৃদয় শান্ত ;
ঘুমাব আমি তাই ঘুমপাড়ানি গানে
ভরেছে চরাচর মিলেছে প্রাণে প্রাণ
তবুও ভিড় করে ; মুখেরা ভিড় করে ;
অতীতে এত জ্বালা ; কে আগে জানত!
দোসর কেউ নেই, চাই নে মিতালিও
তবুও পিছু ডাকে বিদুর, পার্থ।
কী হবে প্রেম দিয়ে, দেহের জ্বর সেও ;
রাধার মুখ তবু কেমন আর্ত!
ঘুমুতে চাই আমি মাটিতে বুক মেখে,
মরণ চাই আমি আকাশে মুখ রেখে ;
তবুও হাঁটে তারা— ক্ষুব্ধ বলরাম,
অন্ধ কুরুরাজ, কুরুক্ষেত্র।
[লখিন্দর ১৯৫৩]
মানুষের জীবনে কবিতার তথা শিল্পের প্রয়োজন ঠিক কোথায়, এ-প্রশ্নের সর্বজনগ্রহ্য কোনো উত্তর যে নেই, তা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। স্পষ্ট হয়ে এসেছে এ-কথাও যে, আজকের পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনে কবিতার কোনো উপযোগিতা নেই ; কবিতার গৌরবের দিন অতিবাহিত। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর বাইরে পড়ে রইলেন যাঁরা, শুধুমাত্র তাঁদেরই এক ক্ষুদ্রাংশের সম্মুখে কবিতা আবির্ভূত হয়। সে আবির্ভাব নানা প্রকার ; কোথাও সে মধুর ও শান্ত, কোথাও বিষন্ন, কোথাও ক্রুদ্ধ ও অস্থির, ধ্যানমগ্ন কোথাও, কোথাও উদাসী, কোথাও ভীষণ ; কখনও সে বায়ুর চেয়ে সূক্ষ্ম, আগুনের চেয়েও রক্তিম কখনও, কখনও লোহার চেয়ে ভারি। যে মানুষটির রচনা-বিষয়ে ভাবনা আদান-প্রদান করতে আমরা আজ সমবেত হয়েছি, তিনি যে কবিতার দেখা পেয়েছিলেন এ বিষয়ে অন্তত আমার মনে কণামাত্র সংশয় নেই। আপনারা লক্ষ করে থাকবেন, চল্লিশ বছর ব্যাপী কালমঞ্চেরও অধিক সময় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর রচনা থেকে মাত্র কয়েকটি লেখা কুড়িয়ে এনে এখানে সাজানো হয়েছে। কবিতাগুলি যে ক্রমে লেখা ও প্রকাশ করা হয়েছিল তার ঠিক বিপরীত ক্রমে সেগুলি পাঠ করার পিছনে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। শেষ কবিতা থেকে পিছিয়ে এসেছি আমরা, পিছিয়ে আসতে আসতে ভাবছি কোন ব্যথা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে কবিতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল, কবিতার পথ তাঁকে কোনো গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে পেরেছিল কি না, তিনি যে আলোর উল্লেখ করতেন বার -বার, সে আলোর রশ্মি তাঁর মুখের উপর, তাঁর সহোদরদের মুখের উপর এসে পড়েছিল কি না, হারিয়ে যাওয়া, পিষ্ট হয়ে যাওয়া আত্মসম্মানবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কবিতা সহায়তা করতে পেরেছে কি না, তাঁর সারাজীবনের কাজ ও অবসাদের কোনো তাৎপর্য সত্যিই আছে কি না।
মানুষ। ক্ষুদ্রাকৃতি এই শব্দটির এ-কূল ও-কূল এক সঙ্গে দেখা যায় না। চেতনা। আরও একটি নিরাভরণ শব্দ, কয়েক লক্ষ বছরের শ্রম যার প্রতি নিবেদিত রয়েছে। এই দুটি শব্দই, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনার কেন্দ্র, তাঁর ভালোবাসার ক্ষেত্র। এই দুটি সম্পদ যখনই বিপন্ন হয়েছে, তখনই ছুটে গিয়ে তিনি বুক পেতে দাঁড়িয়েছেন ; কখনও-কখনও তাঁর আর্তকন্ঠ থেকে অপূর্ব সুর নির্গত হয়েছে, কখনও-কখনও। চিৎকার করতে করতে তাঁর গলা ভেঙে গিয়ে সুর বেঁকে গিয়েছে, আবার কখনও, অসহায় শিশুর মতো কেঁদে উঠেছেন তিনি, কিন্তু কোনোদিন, কোনো অবস্থাতেই বিনা যুদ্ধে এক পা স'রে আসেননি। মানুষকে ভালোবাসবার দায়ভার, মনুষ্যচেতনাকে রক্ষা করার কাজ, তাঁর বিবেচনায় এমনই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিল যে কবিতার জন্য অন্য কোনো দিক তাঁর মনোযোগ অধিকার করতে পারেনি। অথচ, আমরা জানি, একজন কবিকে শুধু কবিতার বিষয়বস্তু নয়, ভাষা নিয়ে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় গঠনপদ্ধতি নিয়ে শব্দ সাজাবার বিদ্যা অর্জন করতে হয়, অনুশীলনের একটি প্রক্রিয়া পেরিয়ে আসতে হয়। বিদ্যালাভ ও কষ্ট স্বীকারের এই দিকটি পৃথক অভিনিবেশের দাবি না করলেও, একজন কবি এগিয়ে যেতে-যেতে তাঁর নিজস্ব কাব্য ভাষার সন্ধান কীভাবে পাচ্ছেন, কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে সেই ভাষা, এ বিষয়ে পাঠকের স্বভাবতই কৌতুহল থাকে। বিভিন্ন সময়ে কবি কর্তৃক প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের মুদ্রিত রূপ থেকে আমরা অবগত হয়েছি যে ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি জীবনানন্দ ও বিষ্ণু দে'র লেখা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সমগ্র কাব্যভাবনা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে আরও কয়েকটি নামের সূত্র আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোবিন্দ চন্দ্র দাস, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র। জন্মলগ্ন থেকেই চল্লিশের দশকের প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন ও তাঁর মধ্যে যুগপৎ নৈকট্য ও দূরত্ব ছিল, এ কথাও আমরা জানি। এতদসত্ত্বেও, মনে হয়, কোনো সন্তোষজনক উত্তর আমরা পেলাম না যেন, তাঁর লেখার পূর্বসূত্র শনাক্ত করতে আমরা বোধহয় ব্যর্থই হয়েছি। এইভাবে বার বার ব্যর্থ হয়ে তাঁর কবিতার কাছে ফিরে ফিরে গিয়ে আমার মনে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে এই প্রকার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে যোগসূত্র স্থাপন করা যাবে না। তিনি সেই বিরল সংখ্যক লেখকদের একজন যাঁকে কোনো বিশেষ অগ্রজ লেখকের পদাঙ্ক অনুসরণকারী হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না ; বস্তুতপক্ষে, তিনি নিজেই সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার একটি প্রস্থানভূমি, তাঁর কবিতা বাংলা সাহিত্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা, অথচ একই সঙ্গে একথাও মনে হয় যে তাঁর কবিতা যেন যুগ যুগ ধরে আমাদের সঙ্গেই ছিল, বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে এতটুকু বিচ্ছেদ যেন কোথাও ঘটেনি। এক অপ্রতিরোধ্য কবিত্বশক্তির প্রাবল্য তাঁকে কেমন করে স্বীয় ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল তা অন্তত আমার কাছে ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে, কিন্তু দেখতে পাই কবি জীবনের প্রারম্ভেই তিনি রচনা করেছেন 'দোল ও পূর্ণিমা'র মতো নিখুঁত ইমেজিস্ট কবিতা, রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দীপ্ত করার উপযুক্ত আকৃতিযোগ্য রচনা, লোক কবিতার আদলে গড়ে তোলা সার্থক ব্যালাড, ব্যাকরণসম্মত চতুর্দশপদী কবিতা। লেখার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে-যেতে, সময়ের আগুনে পুড়তে-পুড়তে, জন্ম নিয়েছে তাঁর মধ্যপর্বের স্মরণীয় রচনাগুলি যার কিছু কিছু দৃষ্টান্ত আজ আবার আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করার প্রয়াস পেয়েছি। অবশেষে, অন্তিম পর্বের রচনায় এসে, আমরা দেখতে পাই এক অন্যরকম ভাষা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অবশেষে পৌঁছে ছিলেন সরল উক্তির এক নিষ্পত্র, পুষ্পহীন, নিরানন্দ মনোজগতে :
যারা এলেন তাঁদের আমি চিনি না
তাঁরা আমাকে স্পর্শ করে বললেন, 'তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন '।
যাঁদের চিনি তাঁরা কেউ আজ আসেন নি।
এখন আকাশে সন্ধা নেমেছে, একটি দুটি তারা দেখা যাচ্ছে।
আমি প্রতীক্ষা করছি, যে-কোনো চেনা মুখের জন্য।
আপনাদের সম্মুখে কিছুক্ষণ পূর্বে যে কবিতাগুলি পাঠ করেছি সেগুলি আবার স্মরণ করতে আপনাদের অনুরোধ করি। আমরা আজ বিবর্ণ, পাতা-ঝরা, শুকিয়ে যাওয়া, কিন্তু আপাদমস্তক ঋজু একটা গাছ দেখেছি ; এই গাছই একদা ফুলে ও ফলে ভরে উঠেছিল, বৃষ্টির জল তাকে দিয়েছিল লাবণ্য, আধছেঁড়া ঘুড়ির মুকুট পরে সে একদা ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছিল। আজ সেই রূপ ও বল কোথায়! সেই ক্ষমতা তার আর নেই, একথা যতটা সত্য, কি ততটাই সত্য একথাও যে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়নি সে, কালের অমোঘ নিয়মে তার অঙ্গে একটি নতুন, সবুজ পবিত্র পাতা একদিন দেখা যাবেই। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়, বিশেষ করে তাঁর অন্তিমপর্বের লেখায়, শুভ চেতনার পুনরুত্থানের একটি সম্ভবনা আমি দেখি। বাংলা কবিতার বাঙালির জীবনের এই ঘোর দুর্দিনে, তাঁর কাছে নতুন করে শেখা একটি বাক্য আমি বারংবার উচ্চারণ করতে চাই— 'আশা অবিনাশী'
২
যে কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আজকের আলোচনা আমরা শুরু করেছিলাম তাদের মধ্যে দুটি প্রশ্ন এখনও স্পর্শ করা হয়নি। প্রকৃত অর্থেই, প্রশ্ন দুটি অতল, শুধুমাত্র বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ক্ষেত্রেই এগুলি বিচার করা হয়তো সঙ্গত হবে না। এক, ক্ষতিপ্রাপ্ত আত্মমর্যাদা ফিরে পাবার, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে, কবিতার, অথবা বৃহত্তর অর্থে শিল্পের, কোনো অবদান কি আছে? দুই, এই কাজে যাঁরা আত্মনিয়োগ করলেন, তাঁদের জীবনের সার্থকতা কোথায়? এই দুই বহু আলোচিত প্রশ্ন আজ আবার আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।
একে অপরকে আমরা কবে প্রথম অসম্মান করতে শিখেছিলাম? এর উত্তর অজানা, তবু অনুমান করি, সভ্যতার উন্মেষের পূর্বে, মানুষ যখন বন্যপ্রাণী, তখন থেকেই, সেই আদি কমিউনের যুগ থেকেই, সম্মান হারানোর খেদ ও হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ, এই দুই অবস্থাই আমাদের নিত্যসঙ্গ। আর, শিল্পের জন্ম হল কবে? শিল্পকর্মের যে প্রাচীনতম নিদর্শনগুলির সন্ধান আমরা পেয়েছি সেগুলি আফ্রিকা মহাদেশের এবং সেগুলি আনুমানিক পঞ্চাশ অথবা ষাট হাজার বছর পুরোনো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০,০০০ থেকে ২৫,০০০ সনের মধ্যে আজকের ফ্রান্সের Lascaux এ নির্মিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুহাচিত্রগুলি। যা রক্ষিত হয়নি অথবা যা আজও খুঁজে পাইনি আমরা, তা যদি কোনো মন্ত্রবলে সহসা ফিরে পেত মানুষ, আমি নিশ্চিত তাহলে স্পষ্ট বোঝা যেত, আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে তিন লক্ষ বছর পূর্বে, যখন Homo erectus আগুনের ব্যবহার শিখে গেছেন, অস্ত্র নির্মাণে যখন দক্ষতর হয়ে উঠেছেন, তখন থেকেই তাঁরা পাথরখণ্ডের উপর অকারণে আঁচড় কাটতে, পশুর হাড়ে ফুঁ দিয়ে শব্দ নির্মাণ করতেও শিখেছেন। আদি মানবের চেতনায় বিস্ময়বোধের জন্ম সবে হয়েছিল, শিল্পবোধের বীজ রোপিত হয়েছিল তখনই, একথা অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত হবে না।
কালের প্রভাবে মানুষের নিজেরই উচ্চাভিলাষের কারণে, জীবন যত জটিল হয়েছে, জীবনসংগ্রাম হয়েছে যত ক্লেশময়, মানুষের অনুভূতির ব্যপ্তি ও গভীরতা তত বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু অপরপক্ষে মনের বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম তখনও তার হস্তগত হয়নি। অনুভূতির চাপে, প্রয়োজনবোধের তীব্র ক্ষুধা থেকে ক্রমে গড়ে উঠেছে ভাষা, মানুষের জীবনের সুর ভেসে উঠেছে। এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, আগুনের ব্যবহার ও কৃষিবিদ্যার পর, ভাষাজ্ঞান মানুষের অগ্রগতির প্রধান সোপান ; লক্ষাধিক বছর জুড়ে বিমূর্ত ভাবনা, শোক ও হর্ষের যে নানা স্তর জমে উঠেছিল মানুষের চেতনায়, ভাষাকে অবলম্বন করে তা নিষ্ক্রমণের একটি পথ সবশেষে খুঁজে পায়। আমরা বিমূর্ত ভাবনা, শোক ও হর্ষের উল্লেখ করেছি, কিন্তু অপমান ও বিপন্নতা? সময়ের পথে চলতে চলতে অপমানের চিহ্নগুলি আমরা কুড়োতে কুড়োতে আসিনি কি? অন্ধকারে নেচে ওঠা হাজার হাজার বছরের পৈশাচিক হাসি ও উল্লাস আজও ঘিরে নেই আমাদের, এতদিনের সে সঞ্চয় কি প্রত্যয়ের জন্ম দেয়নি? সে অপমান ও অসহায়তা শুধুই অপমান ও অসহায়তা তা এখানে আমাদের ভাবনার বিষয় নয়, কিন্তু অপমান ও অসহায়তা আরও কিছু, যার প্রভাব স্থায়ী ও গভীর, যে বোধ শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয়েছে সম্পদে, আমাদের শক্তি দান করেছে, আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া মানুষকে আবার উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, তাকে উপেক্ষা করবে কে? প্রশ্নটি আমাদের আজও বিদ্ধ করে, অনাগত প্রজন্মের মানুষকেও বিদ্ধ করবে। কে আছেন আমাদের মধ্যে যিনি অপমান আর অসহায়তাকে উপেক্ষা করেন?
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিজীবন কেটেছিল প্রধানত এই শহরেই, কিন্তু তাঁর চেতনা এখানে আটকে পড়েনি। কবিতার ভিতর দিয়ে আমরা তাঁকে আদিম মানুষের, তথাকথিত অনুন্নত মানুষের পৃথিবীতে বার বার ফিরে যেতে দেখেছি। দেশ ও সংস্কৃতির অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান— কোনো ব্যবধানই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই অভীপ্সাকে দমন করতে সক্ষম হয়নি। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, কোনো অজানার গভীরে, কোথাও, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এঁদের জন্য নাড়ীর টান অনুভব করতেন এবং ছটফট করতেন। এই নাড়ীর টান, তাঁকে দিয়ে আফ্রিকার প্রাচীন মানুষদের ও এস্কিমোদের কিছু কিছু লোকোগাথা বাংলায় অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে ; সেগুলি কতটা মূলানুগ তা নিয়ে কণামত্র দুর্ভাবনা আমার নেই, সেগুলি আমরা তাঁর মৌলিক রচনা জ্ঞান করেই পড়েছি। এই অনুবাদগুলির ভিতরেই কিন্তু একটি গোপন সূত্র রয়েছে যা অনুসরণ করলে আমাদের দৃষ্টির সম্মুখ থেকে পর্দা সরে যেতে পারে। এই অনুবাদকর্ম আপাতদৃষ্টিতে সামান্য, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি বাষ্পের এক সেতু যা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা, বাংলাভাষার শেষতম এবং শ্রেষ্ঠতম আদিম কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় বহু, বহু, বহু শতাব্দী, তাঁকে যুক্ত করে মহাপৃথিবীর, মহাকালের অসংখ্য অজ্ঞাতনামা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যাঁদের একজন নিজেকে এইভাবে প্রকাশ করেছে
আমার হাসি আসছে, কারণ আমার
শ্লেজ গিয়েছে ভেঙে। আমার শ্লেজের পাঁজরা গেছে ভেঙে ;
আমার হাসি আসছে, হো-হো ! হা-হা !
বরফ, সে কী শক্ত ! দিলো এমন প্রহার ;
আছাড় খেয়ে, কোমর ভেঙে ডিগবাজি খায় শ্লেজ !
হাসতে গিয়ে, হো-হো ক'রে হাসতে গিয়ে
নিজেকে আমি ধমকে উঠি। নিজেকে আমি ভীষণ ধমকাই।
—আহাম্মক ! তোর শ্লেজ গিয়েছে ভেঙে।
শ্লেজ গিয়েছে ভেঙে, ঠুঁটো জগন্নাথ !
এখনও তুই হাসিস !
[ এস্কিমোদের লোকোগাথা / মহাপৃথিবীর কবিতা ১৯৭৭]
ঋণস্বীকার ও কৃতজ্ঞতা :
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি
১৪ সি ঢাকুরিয়া স্টেশন রোড কলকাতা-৩১
Comments
Post a Comment