বিদুর ব্লগজিন।। গদ্যকার কালীকৃষ্ণ গুহ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : গৌতম বসু

গদ্যকার কালীকৃষ্ণ গুহ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : গৌতম বসু
‘পথচ্যুত উল্কার চিতাগ্নি’ শীর্ষক নিবন্ধে শ্রী কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর পূর্বগামী লেখক-সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ-এর কবিতা ও চিন্তার জগৎ ধ্রুপদীলক্ষণাক্রান্ত, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র এক সার্থক উত্তরসাধক ; সুধীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মানুরাগী পিতার দম আটকে-যাওয়া পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তি আস্বাদন করেছিলেন ─ এইধরনের বহুচর্চিত ভাবনাসূত্র থেকে শুরু করলেও, কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য-মূল্যায়নকে আরও বহুদূর প্রলম্বিত করেছেন, পুরানো প্রশ্নগুলি নিজের কাব্যপাঠের আলোকে নতুন ক’রে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
অধুনা,
সুধীন্দ্রনাথ ততটা অনালোচিত নন, যতটা তিনি অপঠিত । নানা কারণে তা ঘটে
থাকতে পারে ; এটি তাঁর লেখা ঘিরে অনভিপ্রেত বিস্মৃতির পূর্বাবস্থা হতে পারে, হতে
পারে বাঙালীর প্রাণবায়ু সঙ্কোচনের একটা সাময়িক পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছে ব’লে তরুণ
পাঠক সমাজ তাঁর কবিতার বই ও গদ্যগ্রন্থগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এমন কি এমনও
হওয়া অসম্ভব নয় যে, তাঁর লেখার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে, তিনি আবেদন হারাতে
শুরু করেছেন । কালীকৃষ্ণ গুহ , তাঁর
স্বভাব অনুসারে, এ-প্রসঙ্গে উচ্চস্বরে কিছু না-বললেও সুধীন্দ্রনাথ-এর প্রতি তাঁর
পক্ষপাত খুব স্পষ্ট,সুধীন্দ্রনাথ-এর অটল অবস্থান সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয়
নেই । তাঁর আলোচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে ।
৷৷ ২ ৷৷
প্রথমেই, সুধীন্দ্রনাথ-এর লেখার স্বল্পতার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে
আলোচক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন : ‘কিছু পাবার নেই ব’লে না–পাওয়ার মুক্তি । দীর্ঘ এক
আত্মজিজ্ঞাসার পথ পরিক্রমণ করার পর না-পাওয়ার বা শুধু ‘না’ উত্তর
পাওয়ায় মুক্তি ─ দীর্ঘ জ্ঞান-অন্বেষণের পর ‘না’ এসে মুক্তি বা
সমাপ্তি । এই হল ভাবুক বা দর্শনপথিক সুধীন্দ্রনাথের অবস্থান, যিনি বলার মতো কথা না
জমলে কিছু বলেননি, নিরন্তর লিখে যাবার জন্য
লেখেননি কিছু।’ (‘কালীকৃষ্ণ
গুহ-এর গদ্যসংগ্রহ’, পৃষ্ঠা ৫১) আলোচক অনুমান করেছেন সুধীন্দ্রনাথ–এর এই নীরবতা
ছিল আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত, এবং ‘একটা অনুধ্যানকে সুস্থির রাখার জন্য’ এই নীরবতা
‘অনতিক্রম্য ছিল তাঁর জীবনে’ । ‘অনুধ্যানকে সুস্থির রাখার জন্য
নীরবতারক্ষার প্রয়োজনীয়তা সঙ্ক্রান্ত মন্তব্যটি আমরা সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে
পারলাম না, অনুমান করছি , আলোচক বলতে চাইছেন, সুধীন্দ্রনাথ-এর জীবনে বলার মতো কথা
ফুরিয়ে এসেছিল । আলোচকের মন্তব্যটি ২০০২
খ্রিস্টাব্দের,এবং তা আজও ঈষৎ কর্কশ শোনালেও, মানতেই হয়, তাঁর মত অভ্রান্ত । বস্তুত, এই মন্তব্যের অল্পকাল
পূর্বেই সুধীন্দ্রনাথ-এর প্রথম প্রামাণিক জীবনী (‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ : অমিয় দেব) প্রকাশিত হয়ে গেছে, যেখানে ২৮.০২.১৯৪৬-এ বুদ্ধদেব বসু-কে লেখা এই চিঠি উদ্ধার করা হয়েছে :
‘ আমার রেডিও বক্তৃতা আপনার ভালো লেগেছে জেনে কতটা উৎসাহিত ও উল্লসিত হয়েছি
তা লিখে বোঝানো শক্ত । তাহলেও বক্তৃতাটা মোটেও সুলিখিত নয় । তার সময় ছিলো না ; শেষ দিনে
রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে কোনোমতে সেটা শেষ করেছিলুম প্রতিশ্রুতিরক্ষার জন্যে । পাঁচ
বছর বাংলা লিখিনি ...’
সুধীন্দ্রনাথ-এর লেখার ধারাবাহিকতা চূর্ণ হওয়ার
পিছনে গভীর কোনো দার্শনিক কারণ থাকা সম্ভব, যেমন কালীকৃষ্ণ গুহ লিখেছেন, আবার এমনও
হতে পারে ‘উত্তরফাল্গুনী’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৪৭ /১৯৪০) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার
পর থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভাঙন, এর জন্য আংশিক দায়ী । সাহিত্য রচনার জন্য ন্যূনতম যে প্রসন্নতা
প্রয়োজন তা সাময়িক ভাবে তিনি হারিয়েছিলেন । অনেকের লেখক-জীবনে গ্রন্থপ্রকাশের
ধারাবাহিকতা না-হলেও রচনার ধারাবাহিকতা থাকে, অনেকের জীবনে তা নানা ঝড়-ঝাপটায়
ছিঁড়ে যায়, যেমন আমরা সুধীন্দ্রনাথ-এর ক্ষেত্রে দেখছি, কিন্তু কেবল এই দৃষ্টিকোণ
থেকে কবিতার মূল্যায়ন করা অতিবিপজ্জনক এক প্রবণতা । কালীকৃষ্ণ গুহ খুব ন্যায়সঙ্গত ভাবেই
সুধীন্দ্রনাথ-এর জন্য উচ্চস্থান সংরক্ষণ করেছেন, তাঁর ভাষ্য অনুসারে, প্রবহমান এক
‘অনুধ্যান’-এর উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন ।
আপাতদৃষ্টিতে, সাহিত্য থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়লেও,
সুধীন্দ্রনাথ যে এক মুহূর্তের জন্যও, এক
ছত্র কবিতা ভুলতে পারেন নি, তার নানা চিহ্ন ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনে। তাঁর প্রথম
প্রবন্ধ সঙ্কলন প্রকাশিত ১৩৪৫ / ১৯৩৮–এ ; এর দুই দশক পরে সিগনেট প্রেস (দিলীপকুমার
গুপ্ত) কর্তৃক প্রকাশিত দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য (প্রথম প্রকাশ : ১৩৬৪/ ১৯৫৭) লিখিত ‘পুনশ্চ’ শিরোনামের একটি
মর্মস্পর্শী রচনা পাঠ ক’রে আমরা আশ্বস্ত হই : অকালমৃত্যুর মাত্র চার বছর
পূর্বেও তিনি কবির ‘নর্ম, কর্ম ও মর্মের একীভাব’কে এবং ‘শ্রেয়োবোধ’কে উচ্চতম আদর্শরূপে ধার্য
করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘...আমার জন্মভূমিকে আমি ভালোবাসি ব’লেই, আমাদের
জীবনযাত্রায় শ্রেয়োবোধের সার্বত্রিক অভাব আমার কাছে অত্যন্ত শোচনীয় ঠেকে।’
কোনও অলৌকিক উপায়ে আজকের বাঙালীসমাজের সঙ্গে
সুধীন্দ্রনাথ-এর যোগাযোগ ঘটে গেলে তাঁকে যে নিন্দাবর্ষণের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ
ক’রে নিতে হত, সে-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই । তদুপরি, তাঁর সমাজসচেতনতার যে ভ্রান্ত
চিত্র আমাদের সামনে সাধারণত ফুটে ওঠে, তা একজন তাত্ত্বিকের, একজন দূরবর্তী দর্শকের; ততটা নির্লিপ্ত তিনি থাকতে
পারেন নি, এবং এখানেও তাঁর সতর্কবাণী উপেক্ষিত রয়ে গেছে ।
৷৷ ৩ ৷৷
দ্বিতীয়ত,
সুধীন্দ্রনাথ-এর রচনায় এক কূটাভাসের দিকে আলোচক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । ‘আমার
কাব্যজিজ্ঞাসায় আধার আধেয়ের অগ্রগণ্য’, প্রবাদে উত্তীর্ণ হওয়া সুধীন্দ্রনাথ-এর
উক্তি আরও একবার উল্লেখ ক’রে কালীকৃষ্ণ গুহ লিখছেন (‘কালীকৃষ্ণ গুহ-এর গদ্যসংগ্রহ’, পৃষ্ঠা ৫২),
‘কিন্তু অবাক লাগতে পারে ভাবতে যে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা স্পষ্টতই আধেয়-শাসিত,
বক্তব্যপ্রধান বা বক্তব্যনির্ভর।’ সৌভাগ্যবশত, এখানে কোনও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়
নি, কারণ, আলোচক তাঁর পাঠ থেকেই একটি সমাধানসূত্রের সন্ধান পেয়েছেন, আমাদের
জানাচ্ছেন যে, সুধীন্দ্রনাথ আধারকে গুরুত্ব দিয়েছেন ব’লেই ‘তাঁর আর্তি বিরহ
আত্মজিজ্ঞাসা এবং নিঃসঙ্গের অনুধ্যান আজও
আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।’
আলোচকের এই বার্তা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এইটুকু কথা
সেরে নিলেই আমাদের প্রয়োজন ফুরোচ্ছে কি না, সে এক স্বতন্ত্র প্রশ্ন । সুধীন্দ্রনাথ
কোন্ আধার নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, ধ্রুপদী না রোম্যানন্টিক, এই মূল প্রশ্নটিই
আজও অমীমাংসিত। তাঁকে একজন ধ্রুপদী কবি রূপে আখ্যায়িত করার অন্যতম প্রধান বাধা
এসেছিল বুদ্ধদেব বসু-র পক্ষ থেকে, যিনি প্রত্যয়ের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ-কে
রোম্যানন্টিক গোষ্ঠীতে অন্তর্গত করেছিলেন । এতগুলি বছর পেরিয়ে আসার পরেও বুদ্ধদেব
বসু-র যুক্তিশৃঙ্খলা খণ্ডিত হয়েছে, এমন খবর আমাদের কাছে নেই । আমরা তাঁকে পাশ
কাটাবার চেষ্টা ক’রে যদি বলি যে, সুধীন্দ্রনাথ-এর বাইরের চেহারাটি
ধ্রুপদীলক্ষণাক্রান্ত, কিন্তু অন্তরে তিনি একজন রোম্যানন্টিকের কোমল হৃদয় ধারণ
করতেন, তা হলে নতুন ও জটিলতর সমস্যাগুচ্ছ
ভেসে উঠবে। সুধীন্দ্রনাথ-এর ‘আত্মজিজ্ঞাসা’র প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেও নানাবিধ
প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ, আদ্যন্ত তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী লেখক, সংশয়ের অনিশ্চিত
ক্ষেত্রগুলি কখনওই তাঁর কবিতায় স্থান পায় নি। সবার নেপথ্যে তিনি প্রথমেই সংশয়গুলি
দূর করেছেন, অন্তত দু’টি পরস্পরবিরোধী মত তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত নিজেকে প্রকাশই
করেন নি । বস্তুত, এটিই তাঁর মনীষার অনন্য রূপ, নিজেকেই নিজের প্রতিপক্ষজ্ঞানে
অবিরাম শেলবর্ষণ ! তদুপরি, রীতি কাব্যের আত্মা, এই বাক্যটি যদি আজও
মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে থাকে, তা হলে আধেয়ের শেষ কোথায় এবং কোথায়ই-বা আধারের
আরম্ভ, তা নিয়ে নতুন ক’রে আমাদের ভাবতে হবে । যতদিন, নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুসারে,
প্রাথমিক স্তরের জটগুলি আমরা ছাড়িয়ে নিতে
না-পারছি, ততদিন, কূটাভাস রয়ে যাবে অক্ষত ।
পুনঃপ্রকাশ
Comments
Post a Comment