বিদুর ব্লগজিন।। তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা।।


তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়-এর গুচ্ছ কবিতা 


বিজল্পসীবন

 

এক

নিপাতনে বাঁকা কাল হাড়ের ভিতরে।

পেলব জরায়ু দিল সন্তানপ্রবাহ। ভিড় এই। জন এই।

আঙুল শৈলীর ধ্বনি নামিয়ে রেখেছে জেনে

এখনও মানব কাঁপে স্মৃতিশলাকায়।

অগুরুত্বে কাটা হাড় কালের ভিতরে। সন্তান ডিমের গায়ে

হাত রেখে মায়া ফিরে পাবে?

পালনে লালনে মাংস ঘর হয়ে গেছে।

 

দুই

জগতে মৌনতা শ্রেয়। স্বপ্নে কথা ঐক্যে কামুক।

বিদগ্ধ দগ্ধের পাশে মোম রেখে সাজাল আগুন।

সৌরসৃজনের এত অপব্যাখ্যা শিল্পের তলায় কারা রেখে

মৃত আজ? নিষ্পাপের কৌম থেকে ছুটে আসে ভক্ত কুকুরের

স্তব, নমস্কার, আর্তি। মানব কেবল ভৌ বোঝে।

ভক্তের চক্ষুই মুখ। ভক্তের ক্লীবাত্মা স্ফূর্তিরূপ।

জগতে মৌনতা ঋত। কথার কবরে কথা, কথার কৃন্তকে কথা।

এত স্ব রয়েছে জেগে, বোবা হওয়া ধর্ম মনে হয়।

 

তিন

অন্তের নীরব আঁকে সারিন্দা শুরুর।

বালি পাহারায় কোটি আঙুলের ফাঁক। মনে হল খসে যাওয়া

এখনও চ্যুতির মতো সরাসরি নিস্পৃহ নয়।

সারিন্দায় ধাতুজিভ টানা হল। শুরু হল সভ্যতা নাচানো।

দুদিকের মেরু মিশে দেশ ঠিক রেখা করে দেবে।

এভাবে পথের আখ্যান শেষ। অধিগত যাত্রা যেন আয়ুবিন্দু, গান।

ভারী সন্ধ্যাকাল নড়ে। অন্তের নীরবে কাঁপে খেজুরের এঁটো এঁটো বীজ।

 

চার

চাঁদ মরে ইতি, ঢেউ। লক্ষাধিক চাঁদ সম্ভাবনা।

উটের নিজস্ব দেশে বাহনও উটের,

জনের নিজস্ব দেশে জন যেরকম। চাঁদ মরে রেখে গেল

জীবিত ফোঁটায় ভরা বিরাট কাজল।

ছিল না সিংহের মুণ্ড আমাদের টোটেম কখনও।

অথচ ইচ্ছা হয়। সিংহ থাক, নেকড়ে থাক, চাতকের হাড় থাক।

চাঁদের গতর গলে তাদের অবয়ব ধৌত, এমন যেহেতু খেলা—

স্নানের পদ্ধতি থেকে জ্যোৎস্না আহরণে জন আসে।

আহত চাঁদের কুঁজে চন্দ্রাহত ভেঙে ভেঙে জল।

এখন গারদে শুধু শুশ্রূষায় নৌকা যাতায়াত।

 

পাঁচ

পা বিষয়ে গুণীজন স্থির।

বেতাল ধারণে কোনো বুড়ি ডাইনি মরে গেছে,

তারও কিছু গতি ছিল? পা ছিল প্রেতের খাস কুটুম্ব কখনও?

পা বিষয়ে আগুপিছু অভিনীত হয়। পা বিষয়ে কাটা জাং মহাপ্রতিষ্ঠান।

গুল্‌ফ ঘিরে বসে থাকা সহজাত কীর্তি, বেতাল ধারণে

নৈপুণ্য দেখাতে গিয়ে গলা মাখনের ঢঙে

প্রলোভনে মরে গেল কারা? অস্থিরতা আয়ুখেকো।

জরাকালে প্রেতসঙ্গ বড় বেশি সাধ হয়। এতেই নরক খুলে যায়।

পা বিষয়ে গুণীজন স্থির। গমন পিছিয়ে গিয়ে পূর্ব গমনের পিতা হল।

 

ছয়

নিঃস্বের কাঁকালে সম্পদ ফুলে যায়, আঙুল অসাড় বলে

তার স্পর্শে মুদ্রা জাগে না।

মোহব্বত ফাটিয়ে যারা শিশুমণ্ড পেয়ে গেছে,

তাদের জগৎ জেনে আমাদের খুশি সেজে থাকা।

বিধান বানাতে চেয়ে নিঃস্বকে প্রভুত্ব দেওয়া... মৃত্যুপরবর্তী, তবু প্রভু।

অপরসায়নে তার জাদু পেয়ে যারা কৃতি হল,

তাদের সঙ্গমে আমরা আগ্রাসন কাঙ্ক্ষা করে আছি।

নিঃস্বের অরণ্যে ঢুকে বিত্ত নিয়ে ফিরে এল শতাধিক মেয়ে।

তাদের বাণিজ্যে রাষ্ট্র বায়ু-বায়ু লিঙ্গ টাঙাবে না?

 

সাত

দ্বিতীয় উপায় পায়ু... নাদমৈথুনের।

অবিবাহ চালু হবে; পুরুষে পুরুষে নাড়ি বিনিময় অচল যেহেতু

উভয়ের ছুরি ছুরি পরস্পর সখ্যে মাখামাখি।

প্রজাতি গুটিয়ে নাও। জগৎ সচল রাখতে গুরুভার এভাবে কমাও।

আর্তনাদ থেকে নাদ

এতদূর সরে গেছে, রতি অন্তে গুরু ছাত্র যেন।

বিকল্প এমনই। পীড়নের শুভারম্ভে লালা, চুমু, প্রতিশ্রুতি, সুখ।

এবার অখণ্ড যুগ্ম উদ্‌গীরণে বোধি পেল বুঝি!

 

চিকিৎসা শাপান্ত করে দূরে নিভে গেছে প্রজনন।

অন্তের এমন শুরু, শুরুর এভাবে ইন্তেকাল।

 

আট

নৌকাবিদ্যা প্রয়োগের সময় এখন নয়।

রক্তের যতটা জল, তার মধ্যে সন্তরণে পূর্বজর ডুবে যাওয়া ভাবো।

গন্তব্য একক। পৌঁছানোর হ্রদ ক্রমে গতি টেনে ধরে, আর

সশব্দে তরী হারিয়ে যায়।

নৌকাবিদ্যা জাগানোর অতীত এমন নয়।

পারাপারে ঘাই ঠোকে পূর্বরমণীর স্তন।

মেদের এমন টিলা, লোভে শস্ত্র কাঠ হয়ে যায়!

এঁকেবেঁকে পড়ে আছে কাদের শুক্রের দাগ? উপত্যকা থেকে

পুরনো মাংসের গন্ধ জলে-জলে ভেসে আসে।

বারণের সংকেত এমন।

নৌকাবিদ্যা মুচড়ে আজ নাবিকের ক্বাথ ফিরে পাওয়া...

ক্বাথের তমসে শুধু দিগভ্রান্তি। অন্য কিছু নেই।

 

 

নয়

লিপি কীটের বমি। এত পাথরের জেগে ওঠা দেখে

ধাতুর শিকড় মনে পড়ে। পাথরে কীটের মাথা ঘষে দিতে

কামগন্ধ ভাষা হল দিনে। ধাতুর শিকড় ঠিক ততটা ধাতব নয়

যতটা জড়ের চলাচল। এইমাত্র নুয়ে গেল হিতৈষী শোকের অন্ত্র,

স্নায়ু পরিপাকে বিঘ্ন ঘটে। লিপিকুশলতা ছাড়া অপর প্রতিভা নেই।

চিত্র লিখে দেখি তার যামিনী লিখিনি। মানব আমিষ— এই ধ্রুব গদ্য

কীটবমি অহং বানাল। পরিবার দাঁত তুলে এগিয়ে এসেছে।

আমার সুস্বাদ নিয়ে এই গ্রহে সংশয় চলে না।

কামগন্ধে মাথা, আয়ু ক্রমশ অবশ, বর্ধমান। ভাষার আকার থেকে

লিপিচরাচর কতদূর? সাযুজ্য গোছাতে গিয়ে দুমড়ে গেল কীটের করোটি।

 

দশ

অভিনীত ভয়ে ভয় জনশ্রুতি হল

যা কিছু পূজার নীতি

             তার থেকে পুজো বহুদূর

 

মাংসের বাগানে মূর্তি

উপাসনা ধারালো করেছে

 

নিচু হয়ে এল দিন

জনশ্রুতি কৌমার্য হারায়

প্রণামে প্রণামে রাজ্য পেয়ে গেছে শোকের দরোজা

 

দু’দিকের আগন্তুক

এ-ওকে প্রভুত্বে পিষে দেবে

 

অভিনীত লোভে লোভ কথামৃত, সাদা

 

                                     জগৎ দুরূহ...

 

এগারো

লুপ্ত গোষ্ঠীর ছায়া নবগোষ্ঠীর বোঁটা মুখে এঁটে

দৌড়ে চলে গেল। দুধের যথেচ্ছ অঙ্গ মাটির উপুড় গায়ে জেগে।

এই পরম্পরা ছাড়া অগ্নি, শব, শ্মশান, সর্বোপরি

দুনিয়া জাগে না। লুপ্ত গোষ্ঠী ত্রিকালসহনে যুত করতে পারেনি;

নতুন যুবতীময় জনপিণ্ডে কশেরুকা ছুঁড়ে ছুঁড়ে কী যে বোঝে,

কাদের গ্রীবার সজ্জা দেখে ফের শাসনের ফাঁদ আঁকতে বসে!

 

লুপ্ত গোষ্ঠী নববৃন্ত কামড়ে ধরে এতদূর গেল,

নতুন কৌমের কোটি খোকাখুকু সোহাগ পেল না। এমনই চৌর্যবৃত্তি,

এমনই তস্করপ্রবণতা।

লুপ্ত গোষ্ঠী স্তন তুলে নতুন শিশুর পুঞ্জ ডাকে।

মাড়ির আদরে তার রাতের চেহারা ফেটে গেছে।

 

একেও কাহিনি ভেবে নতুন গোষ্ঠীর খোকাখুকু

মাড়ি চিরে চিরে ঠিক দাঁতের প্রসব জিতে নেবে।

 

 

 

 

 

 

Comments