বিদুর ব্লগজিন।
অসময়, একটি সংলাপ
১
মানুষের ভাষা আসলে এক শর্তহীন আপোষ—পাহাড়ি নদীর ওপর একটা নড়বড়ে কাঠের সাঁকো, যা অনবরত হাওয়ায় দুলছে; আর নীচের দিকে তাকালেই, আমাদের গলা শুকিয়ে আসতে থাকে ভয়ে।
একই
নদীতে না কি দু’বার স্নান করা যায় না। অথচ, এই যে সাঁকো পেরিয়ে ওপারে গেলাম, আর ওপার
থেকে তাকাতেই খুব অচেনা ঠেকল এদিককার পৃথিবী—একে তাহলে কী বলা যাবে, বোঝার ভুল?
স্বগতোক্তি
আর সংলাপের মধ্যবর্তী শূন্যতাগুলোকেও, আজকাল, পড়ার চেষ্টা করি। আরও দেড়শ’ বছর পর, এই
শহর, তার বাড়িঘর, মানুষজন, এসব কিছুই না কি আর থাকবে না, আপনি বললেন। এমনকী, ছোপধরা
এই ময়লা আকাশটুকুও না কি উধাও হয়ে যাবে আমাদের মাথার ওপর থেকে। আমি চুপ করে শুনলাম
আপনার কথা। কিন্তু, আপনিও জানতেন, সেই অবর্ণনীয় শূন্যতার ভাষা পুরোপুরি বোঝার জন্য,
আরও দেড়শ বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
অপেক্ষা…করতেই
হবে—
২
ধ্বংসের এই প্রকাণ্ড ছবিখানা ফুটিয়ে তোলার জন্য, বাস্তবিক, আমাদের বানিয়ে নিতে হয়েছিল একটা আনকোরা নতুন ভাষা। আমরা দেখেছিলাম, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা ইট-কাঠ-পাথর আর ছেঁড়াখোঁড়া শরীরের মাঝখানে, একটা বন্ধ দরজা, তার ফ্রেমসহ, দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেয়াল আর ছাদ ধ্বসে গেলেও, কোনও এক রহস্যময় ভারসাম্যহেতু, দরজাটি তখনও পড়েনি।
এই আশ্চর্য দৃশ্যের
সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, বলা মুশকিল। সময়ের ধারণাটাই, আমাদের চেতনায়, ক্রমশ আবছা
হয়ে আসতে শুরু করেছিল। মনে হচ্ছিল, দরজা ঠেলে একবার যদি ওদিকে যেতে পারি, তাহলেই হয়তো
এই সমস্তকিছুর একটা সন্তোষজনক অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বস্তুত, সে আছে বলেই, আমরা তাকে
অতিক্রম করার কথা ভাবতে পেরেছিলাম। সে আছে বলেই, আমরা বুঝেছিলাম, ভিতর-বাহিরের প্রশ্ন
এখন অবান্তর। কেননা দরজাটি, তার চারিদিকের শূন্যতাকে, আরো জটিলভাবে বিন্যস্ত করেছে…
৩
অপেক্ষার ছোটবড় শূন্যতাগুলো, ক্রমশ ভরে ওঠে অসমাপিকা ক্রিয়ায়—
হলুদ আলোর নীচে, শরীরের
চুঁয়ে-পড়া অন্ধকার, সিগারেট, ভাঙাচোরা চাঁদ আর নোংরা জলকাদা মাড়িয়ে হেঁটে যেতে যেতে,
অন্যমনস্কভাবে একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে, অপ্রস্তুত চোখ নামিয়ে নেওয়ার আগেই, ভুল করে
একটি কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়তে পড়তে, সহসা পিছন ফিরে, এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় হোঁচট খেয়ে
ছিঁড়ে যাওয়া চটির স্ট্র্যাপে শেষবারের মতো একটি মরিয়া সেফটিপিন আটকে, হাঁটতে হাঁটতে,
অনবরত হেঁটে যেতে যেতে—
আমাদের চোখের আড়ালে,
সমস্ত উদ্দেশ্যহীন পরিকল্পনার ভেতর, এবং সমস্ত পরিকল্পিত উদ্দেশ্যহীনতার ভেতরেও, কোথায়
একটি শান্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলেই ওঁত পেতে ছিল—
আমরা কি বুঝতে পারিনি?
হত্যায়
হত্যায়
সমস্ত পৃথিবী লাল
আমি তাই
জলের আঙুলে ছুঁই
সারাদিন মাথা-নাড়া অবোধ শৈবাল
আমি তাই
চৈত্রের হাওয়ায় হাসি
আমি তাই
পাথরের চোখে রোজ
পাথরের জল এঁকে আসি
অমন নিঃস্ব চোখে
না তাকালে
তোকে
কীভাবে দিতাম দৃষ্টিফুল
গলিপথে
রজোরক্ত
রাস্তায় উড়ে যাওয়া শোক
আর এই এলোমেলো
চৈত্রের হাওয়ায়
তিরতির করে কাঁপা
একটি পাখির মাতৃচোখ
এসো একদিন
আমাদের বাড়ি খুব ভালো, তাকে বলি
এসো একদিন, না হয় খানিক কালঘাম হবে
পায়ে হাঁটা সড়কের অন্তিম গোবর
টপকে এসো মজা পাবে ঠিক
এমনই চকিত কৈশোরের হাই জাম্প, মুখে ধুলো
তারাময়ী স্কুলের প্রাঙ্গণ, খুদে কলেবর বট
হলুদ মুখর কয়েক ঝোপের পোকা
আহা ম্যান্ডোলিন
প্রথমে আমের ঝাঁপি খুলে দেব ঝুড়ি
চিনিরোগ তোমার নতুন, বলো আর কী কী আছে?
অম্বল, ঢেঁকুর চোঁয়া, আমাশয় চাপ
না হয় পরেই এসো কিছুদিন পর
জল ভালো, ক্ষুধায় বিশ্বাস ফিরে এলে
গোলাপে হাওয়ার বেগে উল্লসিত তড়িঘড়ি এসো
ধীর বাক্য, লয়ে এতখানি জল
কথায় মোহনা গড়ে ওঠে
নৌকা বেয়ে মাঝি ও আনাজ যায় দূরে
কতদূর যাবে...
আবার টেনেছ জাল, তটরেখা সামিল হয়েছে
রাত্রিময় গান আর মাল্লাদের ঘরে
উবু কেউ কাঁথা বোনে একা
উঠোনে নিভেছে বাতি শিয়ালের ডাকে
জ্যোৎস্নায় ফেটেছে চাঁদ বরাবর দণ্ডিত এমন
ডিমের জীবন
এতদিন থেকেও বুঝলে না পাখি নয়
মেঘ শাদা চিরকাল আসে
এখন সামান্য বাকি জল
এখন ভাঙানো গম দেখে এসো গোলায় অধিক
সমতল, রৌদ্রভাঙা পটে খাটো বাড়ি
সব গ্রামে রমণীয় ডিম
এসো আরো জল খুলি হাত ধুয়ে থাকি
জুড়ে যায় তাই ও কাহিনী
এতদূর ফুলে আছে লাগাতার ডিমের জীবন
১
সহজ কবিতার দিকে আমরা চলে এসেছি কাউকে না জানিয়ে
যেখানে নদীয়া জেলা দুপুরবেলায় মেঘ হয়ে ভেসে আছে
একটি ম্যাজিকগাড়ি ভাড়া করে চলেছি দু’পাশে নাবাল জমি
ব্যাগে একটি ক্যামেরাও আছে কারণ তোমায় নিয়ে এতদূর
শুধু রেখাময় কবিতার খাতিরে আসা তা কি অভাবনীয় নয়?
যখন রেডিওর যুগ ছিল তখন তো আমাদের চেনাজানাই হয়নি
আলাপ যখন হল তার ষোলো দিনের মাথায় বুঝে গেছিলাম
জলদাগ কীভাবে ভাষা হয়ে ওঠে
কেনই-বা আলো ফোটে অটোরুটে
অনেকগুলো হাতবোমার মতো বছর পেরিয়ে তোমায় পেয়েছি
তার ওপর লেখালেখি নিয়েও কসরত তো কম দিন করিনি
পার হচ্ছি শহর যেখানের গানের মানে কেবল কাচের গেলাস
নয়
ঘাস আছে মানুষের মতো, আছে আটাকল, আভাময় পাখি
টুকরো আকাশ নিয়ে উড়ে বেড়ায় আর তাই দেখে তুমি
ঘাড় ঘোরাও, চুলের রাশি পড়ে আমার মুখে, না সরিয়ে হেসে
ওঠো।।
২
ভিডিও সংক্রান্ত একটি নিরাপদ ভাবনা বাতাসে বাঁক নেয়
কথা হচ্ছিলো পোড়োবাড়ির বিপজ্জনক পাঁচিল ঘেঁষে
তিরিশ সেকেন্ড হাঁটার
পরনে টুক্সেডো, গোলাকার রোদচশমা, কোলে বেড়ালছানা
এবং লাক্ষাপ্রদেশের সেই লোকগান দু’কলি তোমার ঠোঁটে
ঢেউ-এর পর ঢেউ এমন সজীব সাদাকালো গ্রিডের হেমন্তঋতু
শেষ দেখেছিলাম জন বার্গারের একটি অপ্রকাশিত চ্যাপবুকে
কিন্তু আমি বুঝিনি উদ্দীপক ছবির এইরূপ গতিময় খুনখারাপি
শটের একটি ঈগলপ্রান্তে এসে তুমি হাঁটু ভেঙে বসে পড়লে
এই কি দুঃখ, মুদ্রার ও-পিঠ, হায় কী অনন্যোপায় ক্ষিপ্র
যেন উড়ন্ত স্টোভ
বাতিল পত্রিকার কোলাজ তুমি চাওনি রিমোটাশ্রিত জীবন
সরলতা হয়ে যায় লং প্লেয়িং রেকর্ডের মতো প্রাচীন, ধ্বনিময়
শুধু বৃষ্টি নামা বাকি আছে এই শৈল্পিক অঞ্চলে আর তুমি
মুখ তুলে কাঁপা গলায় বললে কুকুরের মতো তাকিয়ে না থেকে
কাট্ বলো।।
৩
নীল একটি বাক্স যখন উজ্জ্বল হয় ভোরবেলার রোদে তার
যাবতীয় নোটপত্তর নিয়ে আমি বুঝি জটিলতায় বহিয়া গেল
করাতকলে ফেলা নশ্বর জীবন হায় কোথায় সুকান্ত ইন্দ্রাণী
কই
অমনপ্রীত কহাঁ হ্যায় তু where are my friends
today যখন
আমি ধূসর লুপ্তপ্রায় একটি সংখ্যামাত্র ঘাড়ে নিষিদ্ধ
উল্কি
আবিষ্কারের গল্পে জ্বরাক্রান্ত এবং হেই ট্যাক্সিইই
রোককে
ড্রাইভার কাকু আপনার কাছে সূত্র আছে আমায় সেই গোপন
আস্তানায়
নিয়ে চলুন যেখানে আমার প্রেমিকা পোশাকে টিপটপ কথায়
আলুথালু
সানগ্লাস কপালে তুলে
প্রস্তুত
নিওন ভেঙে-ভেঙে আমরা সন্তপর্ণে ঢুকে যাব টেলিপোর্টেশন
বলয়ে
সেকি হাহা হাসি আমাদের আপনি নিশ্চয়ই ফোনে ঝাপসা রেকর্ড
করবেন সব
প্রযুক্তিগত কাঠামোয় অসংখ্যা সুইচ কিন্তু রঙিন ম্যানুয়াল
কিতাবে পেয়ে যাব
দরকারি নির্দেশসমূহ আর সাধারণ দক্ষতায় আমাদের আড়াই
কী তিন মিনিট লাগবে
মোটামুটি বুঝতে কোথায় ভালোবাসা বৈকালিক মেলা বসিয়েছে
যুক্তাক্ষরহীন নির্মেদ
কবিতায়
স্ক্রিনে তখন দেখাবে নদীয়া জেলাকোর্ট থেকে দু’মাইল
উত্তর বেল্ট বেঁধে নাও।।
অদৃশ্য ডানার পালক
আপনাকে চিনতে পেরেছি। হঠাৎ ভিড়ের মাঝে শব্দ
ছুঁড়ে দিল কেউ। আমি হয়ত বা সেইদিনই ভুল
পথে বিপরীতমুখী একমাত্র লোকালের কথা
ভেবে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আপনাকে তো চিনে ফেলা খুব
সোজা! হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে কেউ যেন
বলল আবার। আমার টিকিট আছে। শুনছেন? বলামাত্র
তার ডানা থেকে একে একে পালক পড়ল খসে
ওভারহেডের তারে, ভাঙা শেডে, রেলওয়ে বস্তি
কলোনির ডেনড্রাইটের ঠেকে। মা তারা লজের
ছাদে যাত্রীরা উড়ন্ত আমাকে দেখে হাতও নাড়ালো
অথচ কবির কথা শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে না পড়া
অবধি বিশ্বাস জানি কেউ করবে না কোনোদিন
২
কার হাতছানি পেয়ে মধ্যরাতে দরোজা খুলেছি
চোখের সীমানা ছাড়া বাদবাকি উপহাস, তারা
হে জন্ম, বিব্রত মূক ও বধির চৌকাঠ। কেবল
দাঁড়িয়ে দেখা আলো আর পোকাদের হাস্যকৌতুক
কখনও বাতিল। জব্দ বেপরোয়া হাওয়ার দাপটে
অবয়ব, সেও বুঝি আতিথ্যের ভ্রম। ক্লান্ত তবু
নিজেরই চিবুক ছুঁয়ে বলিনি কখনও 'ঢের হল
এইবারে ঘরে যাও। চোখে-মুখে জল নাও। বসো।'
৩
পাহাড়ে যাবার ট্রেন। ঘোষণার টুং-টাং তখনও বাজেনি
গা-গতরে ভরা চাঁদ অন্ধ জারুল বন আলো করে আছে
অনুসন্ধান কেন্দ্রের উদাসীন কর্মীটি। গালে অশৌচের দাড়ি
খবর জানতে গেলে মশা তাড়াবার ছলে তার সহজাত
স্বর,
'আরেকটু দেখুন।' এভাবে অপেক্ষার কথা কেউ বলেনি
এর আগে। মালবাহকের স্বরও ভালোবেসেছিলাম তখন
অথবা হাঁসের ডিম ফেরি করা পদ্মমাসির, টিটি পাখি, কুকুরের
ঠ্যাং ভাঙা অবাধ্য ছানারও। টিকিটের গায়ে লেখা সঠিক সময়
আর মাতালের গান। ব্যাগপত্র আঁকড়ে ধরে তাও বহুবছর পেরলো
ঘোষণা হয়নি আর। বাতিল ট্রেনের কথা যাত্রীরাও ভুলে গেছে কবে
মাঝে মাঝে শুধু আসি। টিকিটঘরের কাছে ঘুরঘুর করি
ট্রেন আসে, চলে যায়। থেকে থেকে কেঁপে ওঠে জারুলের বন
শ্লেট
নিরীহ আঁকিবুকি টানে
শিশু হাত, কালচে বল্কল
সহজ পাঠের পাশে আধোআধো
কথাগুলি সজল-সফল
তাকে পুজো করি দিনরাত
রাত-দিন ভকতিসম্ভব।
শ্বেত পদ্মাসনে দেবীরূপে
দেখা দিল আমার শৈশব
কালবৈশাখী
ডুবেছে গহিনে নীল, নয়ানজুলি
জল কেটে কেটে উঠে আসে
আমাদের রোগা সোগা শিশু গুলি
ও গোধূলি পিচুটি
চোখ মেলো, দেখো কি দারুণ বেশে
ঈশানে রাঙানো কালো, ঋণ
আরো এক মায়া ঝড় শেষে
বাড়ি
এঘরের অংশত কালো
মেঘাতুর নিঝুম কোণায়
জালবোনা দেহাতি মাকড়,
অসতর্ক গুছিয়ে রেখেছে
ক্লেদহীন আলোড়িত লাল,
সে কখনো আলোয় দেখেনি
মেলানিন কুরে কুরে খেলে
কিভাবে ছড়িয়ে যায় শ্বেতি
অবহেলে অনিকেত জুড়ে,
এলোমেলো ছড়িয়েছে পাখা
জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা,
আলোমুখী কদলী বাদুড়
জার্নাল ৫০
তোমার শরীর এক প্রাণোজ্জ্বল বালিঘড়ি
বরতনু , বিরতির জিকির বিশেষ
দু’দিন জল না এলে অনুযোগে দর্শনীয় থাকবে না আর
যে-কোনও লড়াই
যাকে কুমকুম বলে
স্বভাব আড়াল করা যায়, তার পাশের বাড়িতে
ভোর ও বৈঠকের মাঝবরাবর হাইফেন
চোখাচোখি হলে তাতে রাশভারী গয়না এসে বসে,
রেখার সরল ঊরু খানিকটা ভাঙে যথাযথ
তুমি ধূপ জ্বেলে রাখ
রাশি রাশি উল্কার পচন যাতে নিজেদের সন্দেহ না করে
প্রহরের নিভন্ত ছায়া
টুপির অভিবাদন নামিয়ে দাঁড়ায় নিশ্চুপ;
ঘন্টার প্রতিধ্বনি চুঁইয়ে যেখানে এসে ঈশ্বরের শেষ…
সবকিছু সন্দেহের বাবা।
সম্বোধন হারিয়ে গেলে টবে যা পড়ে থাকছে,
রৌদ্রময় রোদের মৃতদেহ;
তাই ক্রমাগত ফুলে ট্র্যাফিক
আর কলঙ্ক ঘুচে যাচ্ছে প্রি-পেড রাস্তার।
সুহৃদ আপাতত হাতে পেয়ে
ডায়েরিকে নৈর্ব্যক্তিক ধন্যবাদ একবার।
কেউ দেখে ফেলল কি-না—বারবার পাতা উলটে
মুখমৈথুন ঢেকে নেওয়ার যে সাবেক অভ্যাস
তার মতো রোমাঞ্চই একমাত্র লেখক
যার চোখ পিটপিটে সরলতাগুলো
বছরে দু’একবার এখনও ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে
রাখে।
একলা আপিসে বসে সমাজমাধ্যমে পড়া
প্রেমিকার ভাষা বুঝতে যতটা সময়
তাতে একঘেয়েমির কাছাকাছি কখনও-সখনও
পেঁয়াজি ও বিকেলের স্নিগ্ধতা সিগারেট
টানে।
তখন আপডেট বলতে দেশের বাড়ির স্মৃতি,
তার ঠোঁটে একটা রোগা বোতাম,
কাছেপিঠে কালাচের কম্বু চলন…যা যা
শাস্ত্রে বলা নেই
তার অতিসাবধানী স্পয়লার।
বোঝা যায়
নিজের সময়ের বিরুদ্ধে
যত না-বাচক মাথা নাড়া
যত পংক্তির না-লেখা রুটিন
আলস্য মেনে নিয়ে পিতামহ-দস্তাবেজ
থেকে মাথা তুলে এই খানিকটা
আব্রুথরোথরো যাপনের মার্বেল,
যার পেছনবাগে সজোরে লাথি কষাবার মতো
কেউ বেঁচে নেই,
সবাই শেষতক হাঁটছে
নানারকম ঝোলে
কয়েকটা একইরকম রুটির খাবি খাওয়ার দিকে…
আজকের মতো ছদ্মবেশ সাঙ্গ হল।
মুখে মুখে শ্বাস নেওয়া ইস্পাত
ফুল ছুড়ছে জান্তব মাধুর্যের দিকে।
শ’খানেক দুরন্ত রাজধানীর চোখে-চোখে
ঈশ্বরের লুকোচুরি—
কুটকুটে অতীতের গা-ঝেড়ে উঠে পড়ছে
কম্বলবিধান
এত মায়ার শরীর
তবু সামান্য তদন্তসাপেক্ষ হতে
এত দয়ার শিবির
এত কেন অনীহা, তোমার?
শেষ-কৈশোর
ক্লান্তিতে জলের শব্দ তুমি
ডেকে নাও, অনায়াসে...
পারি না বসতে স্থির ; মোহে
বাড়িয়েই দিই পা ভিজে ঘাসে
এসবই গোপন কথা, কীভাবে যেন কে
একদিন, হাওয়ায় ছড়িয়ে দিল…
জ্বর আসে যদি (!)— এ-কথা ভেবে মা
সেদিন ভিজতে জলে, বারণ করেছিল
জল্পনা
বরং বলেই ফ্যালো— আমিও ক্রমশ জেনে নিই
‘না’-কথাটি
কতটা সর্বোচ্চে যেতে পারে…
তারপর সন্ধ্যা তো নামবেই
তুমিও সময় পাবে; একা একা অন্ধকারে…
সেসব আঁধার, ক্ষত— আমিও ক্রমশ
লেপে দিই
কবিতায়, যতদূর এসে থেমেছে সময়
আসলে যে না-পাওয়ায় নয়
আমার তো শুধুই তোমার অপাত্রে যাবার ভয়
প্রবাদ
যেকোনো দুপুর এভাবেই আসে
তোমার মতো — শান্ত, স্নিগ্ধ
ভরসা করে
এলিয়ে দিই মাথা পরিচ্ছন্ন ঘুমে
তারপর, কখন না-জানি
ভেঙ্গে যায়। চলে যায় সব…
অপূর্ণ এক স্বপ্ন আঁকড়ে নিয়ে
প্রতিবার, বিশ্বাস করতে হয়—
ভাতঘুম এক তীব্র বদভ্যাস
এক
ক্ষিপ্রপদ স্মৃতিদল ক্রমাগত ছুটে বেড়ায় শিরা-উপশিরায়। এই মুহূর্ত, দীর্ঘ দেজাভ্যুর মতো স্থায়ী। চোখ থেকে সরে যাওয়া চোখ– ফিরে আসে একই কক্ষপথে। আরক্ত, বিষণ্ণ দৃষ্টিপথে জেগে ওঠে চিঠির মৃতদেহাংশ। তাকে পিষে হেঁটে যাই... হেঁটে যাই অতীতের দিকে। যে উত্তর কোনওদিন দেওয়া হয়ে ওঠেনি, তাকে পকেটবন্দি করি তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য– যদি কোনো উপকথায়, তোমার-আমার দেখা হয়ে যায়...
দুই
দুর্ভাগ্য একদিন ঠিকই ফিরিয়ে আনে, আদিম দুঃখ থেকে জন্মলদ্ধ সত্যিদের। এই বৃত্ত, নিরন্তর। ফিরিয়ে আনে ক্ষয় ও ক্ষতচিহ্ন। ঔদার্যের পাশে বসলে তুমিও দেখতে পাবে, কীভাবে কেটে যাওয়া ঘুড়ির ঠিকানা মুছে যাচ্ছে অস্তিত্বের মহাকাশ থেকে। ঠিক যেন বহুরূপী আমি, তোমার কল্পপ্রেমিক– ধীরে ধীরে 'আছে' থেকে ভেসে যাচ্ছি 'নেই' এর দিকে...
তিন
শীতের সন্ধ্যা জানে, মায়াদের অনুভূতিক্রম। পথিকের শুধু সাহস সম্বল। তাই সে হেঁটে যায় অনন্তের উদ্দেশ্যে। অথচ যার কোথাও যাওয়ার নেই, সে আজ কোথায় যাবে? আমার চলা থেমে যায়, দেখি– কৈশোরের দিনগুলি ছড়িয়ে পড়েছে পায়ের নীচে। এই মুহূর্ত, শীতকাল... সমস্তই জড়িয়ে যাচ্ছে পদক্ষেপে। আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমারই কিশোরবেলা; পিঠে স্কুলব্যাগ, তাতে শূন্যতা আর মুখমণ্ডলে অসম্ভব সারল্য–
তোমাকে
তোমাকে পাইনি বলে
এক একটি দিনের শেষে জ্বলে ওঠে আকাশপ্রদীপ
স্থাপত্যনির্ভর প্রতিটি সেতুর ফুঁসতে থাকা অভিমান
মেরুর পুঁজ হয়ে ঝরে পড়ে
কেউ খোঁজ রাখে না
মৃত্যুর যে আশ্চর্য গান আছে
নিজস্ব বিলাসী সুর, লয়
আর কথারা উবে যায় দেবতার থুতু হয়ে
সম্মোহন
বিষণ্ণ মেঘের শরীরে বিঁধিয়েছ চণ্ডাল সূঁচ
নির্লজ্জ পথ চেয়ে
কী হারিয়েছ?
সময়ের চাদর খসে পড়লে বুঝবে
আজীবন অপেক্ষা
বিয়োগবিধুর ধানের শীষ
মোহ
অবচেতনে দাঁড়িয়ে আছে নেশাগ্রস্ত সময়
যেখানে নীরব
শোকের থেকেও দামী
মদ্যপ মাটির চোখদুটি
আজীবন তীক্ষ্ণ চিন্তার ভণ্ডামি থেকে বিরত থেকেছ,জানি
ভুলিয়েছ শাশ্বত প্রদীপি ছায়ায়
শুকনো পাতায় বেজে ওঠা ভায়োলিন
নিছক বিছানায়..
Comments
Post a Comment