বিদুর ব্লগজিন।।


অনন্য রায়ের সাক্ষাৎকার

১৯৮৪- মার্চে কবিতাদর্পণে প্রকাশিত অনন্য রায়ের সঙ্গে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথোপকথন। (নির্বাচিত অংশ) 

সঞ্জয়ঃ    আপনার প্রথম বই ‘দুষ্টি অনুভূতির ইত্যাকার প্রবাহ এবং আরও কিছু' যে রকম প্রশস্তিধন্য হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে তা প্রায় বিরল ঘটনা। এখন পিছন ফিরে সে সময়টা ভাবতে কেমন লাগে?

অনন্যঃ  ‘দুষ্টি অনুভূতি ইত্যাকার প্রবাহ এবং আরও কিছু’ আমার ১৫/১৬ বছর বয়সের লেখা একটা তরল দীর্ঘ কবিতা। ওটাকে আমি আমার নিজের লেখা বলে স্বীকার করতে চাই না। খুবই নক্কারজনক কাজ। তবে হ্যাঁ, ১৯৭২ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর কয়েকজন প্রবীণ এবং অনতি–প্রবীণ কবি ( যাঁদের মধ্যে বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্রের মতো কয়েকজন শ্রদ্ধেয় লেখকরাও ছিলেন।) যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন আমার, —বোধহয় আমার বয়েসটাই তখন আমায় গ্রেস মার্ক দিয়েছিল। নইলে ওরকম জঘন্য কবিতা আমি নিজেই দুটো পড়িনি। তবে এখন কবিতা লেখা, কবিতা পড়া কিম্বা অন্যান্য কবিদের সঙ্গে মেলামিশির মধ্যে এক রহস্যময় মাদকতা ও ডেডিকেশান ছিল। কোনো কবির সঙ্গে এক সন্ধ্যায় আড্ডা মারলে নিজেকে বিশেষ সৌভাগ্যবান মনে হতো। এক লাইন কবিতা লিখে মনে হতো, একটা কিছু হচ্ছেটচ্ছে বুঝি। তখন ছোট ছিলাম কি না।

সঞ্জয়ঃ     যুক্তি তক্ক ও গপ্প তোলার সময়ে একজন কবি হিসেবেই আপনি ঋত্বিক ঘটকের সহকারি ও অন্যতম অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। ঋত্বিকের মতো প্রবল শিল্পী ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ কি আপনার জীবন ও কাব্যরীতিকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছিল?

অনন্যঃ    যুক্তি তক্ক ও গপ্প তোলার সময়ও আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম। ঋত্বিক ঘটককে তখন আমি স্বয়ং দেবতা ভাবতাম। যদিও আমার তখন ইচ্ছে ছিল একজন চলচিত্রস্রষ্টা হওয়া, তবু খুবই প্রচ্ছন্নভাবে যদিও, কবি (?) হিসেবে ঋত্বিক ঘটকের মতন একজন প্রবল শিল্পী ব্যক্তিত্বের প্রভাব আমাকে ইতিহাস, রাজনীতি ও পুরাণ সম্পর্কে অধিকতর আগ্রহী হতে শেখায়। যদিও ইয়ুং নামক সলজ্জ ধর্মপ্রচারকের কল্পিত আর্কিটাইপ তত্ত্বে আমি আস্থাবান নই, তবুও, ফার্টিলিটি কাল্‌ট সম্বন্ধে মিহি অবসেশান আমার তখনই গজিয়ে ওঠে। ঋত্বিকদার সংস্পর্শ আমাকে কবি হিসেবেই অধিকতর মননশীল করেছে সন্দেহ নেই। আমার কবিতায় যা আপাতদুর্বধ্যতার কারণ— আমার কবিতায় সেই ক্রস-রেফারেন্স এবং ওভারটোন থ্রো করে বাক্যবন্ধের থেকে  একটা Condensed meaning আদায় করার চেষ্টা আমি তখনই অভ্যেস করি। তাছাড়া ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এবং পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সঙ্গীতের একজন মুগ্ধ শ্রোতা হওয়ায়, একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বরের সম্মিলিত অর্কেট্রেশনে আশক্ত হয়ে পড়ি। (সেই থেকে শুরু হয় আমার পৌনে পাগলামি) । ইতিমধ্যে ঋত্বিকদা আমার কোমল গান্ধার প্রসঙ্গে দৃশ্য ও ধ্বনির একই সঙ্গে দুটো মাত্রায় চলাচল সম্পর্কে বোঝান। ফলত বহুমাত্রিকতার ভূতও আমার ঘাড়ে চাপে সঙ্গে সঙ্গে। এ সবই আমার কবিতায় তখন পরিবর্তন আনে। তার আগে আমি কবিতা লিখতাম নিছক আবেগ ও প্রেরণাবশত।

         তবে, ক্রমেই আমার মনে হচ্ছে ভাষাকে অযথা ভারাক্রান্ত করে বেশী ক্যারদানি দ্যাখাতে গিয়ে আমি কবিতাকে হত্যা করছি। (প্রায় মান্না দে-র গানের মতো সহজ সুরে গিটকিরিকুশলতা! অতটা দরদী নয় এই যা!) জীবনযাত্রার উপর ঋত্বিকদার খুব প্রভাব ছিল না। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের বহু আগে থেকেই আমি ছিলাম নীরন্ধ্র নেশাখোর। ঋত্বিকদা ব্যাপারটাকে আর একটু উস্কে দিয়েছিলেন আর কি! তবে হ্যাঁ একটা ব্যাপারে আমি ওঁর কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ; যে-উনি নিজের পয়সায় অফুরন্ত মদ খাইয়ে খাইয়ে আমাকে উত্তুঙ্গ ড্রাগ এডিকশন থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

সঞ্জনঃ    নৈশ বিজ্ঞপ্তিকে যদি আপনার প্রথম ও শেষ কবিতার বই বলি আপনি মেনে নেবেন?  মানে বলতে চাইছি নৈশ-বিজ্ঞপ্তির পর যা আপনি লিখেছেন তা হয়ত অনেক বিস্তৃত ও গভীর, কিন্তু যাকে বলে কবিতা, তা নয়– আশা করি বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন?

অনন্যঃ    এ প্রশ্নের উত্তরটা আমি আগেই খানিকটা দিয়েছি। ব্যাপারটা হচ্ছে…গ্রীক সঙ্গীতকার ও স্থপতি ত্মিনাকিস্‌কে যখন ভারতীয় ‘দূরদর্শন’ থেকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, আপনি কি মনে করেন না, Middle-C- তেই এখনো অনেক সঙ্গীত লুকিয়ে আছে? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘তা থাকতেই পারে, কিন্তু আমার তাতে কী যায় আসে ?—আমি নতুন কিছু খুঁজছি।‘ ১৯৭৪ সালে ‘নৈশ-বিজ্ঞপ্তি’ বেরনোর পর আমার মনোভাবটা সেই রকমই হয়!... আমি মনে করি, যে কোনো কবিতা তা সে যত মহৎই হোক না কেন, শুধুমাত্র লেখকের নির্বাচিত মানসিকতার অনুশীলিত একাংশকেই প্রতিভাত করে।  তারজন্য দায়ী প্রধানত কবিতার নিজস্ব স্বভাবের ফর্মলি লিমটেশান। এদিকে আমার আশঙ্কা ছিল যে আমার  মানসিকতা বোধহয় শুধুমাত্র কবিতা লেখার জন্য tailor-made নয়। অতএব, আমি তখন খুঁজে বের করতে চাইছিলাম এমন এক প্রণালী, যেখানে— কবিতা, নাটক,প্রবন্ধ, কাহিনী, সঙ্গীত, ও চলচ্চিত্র প্রভৃতি সমস্ত রকম প্রকরণের স্বেচ্ছচারী মুক্ত প্রয়গে— আমাকে আলড়িত করে এমন সমস্ত বিষয়কেই আমার কবিতা রচনার উপজীব্য করা যাবে। তাতে যদি কবিতার কুমারীত্ব নস্যাৎ করা হয়ে থাকে, তো হোক। আমার ইয়ে হলো! As such কবিতা লেখার আমার কোনো দায়িত্ব নেই।। আমি চাই ইতিহাস ও সমাজনির্দেশিত আমার অস্তিত্বের সার্বিক উদ্ঘাটন। এবং সেটা করার জন্য আমি যেকোনো  প্রকরণ, যেকোনো বক্তব্য অবলম্বন করতে পারি। ‘আমিষ রূপকথা’ এবং ‘চুল্লির প্রহর’ -এ আমি তারই চেষ্টা করেছি; কিন্তু বলা বাহুল্য, সফল হইনি। (নিজের কবিতা সম্পর্কে আমার ধারণাঃ ‘নৈশ বিজ্ঞপ্তি’রসময় থেকে আমি পাশাপাশি দুটো শব্দ-বসানোর কায়দা রপ্ত করেছিমাত্র। একখানা ভালো কবিতা কেন, একখানা স্মরণীয় পংক্তিও আমি আজ পর্যন্ত লিখিনি।! )আমার এই বায়বীয় স্বৈরাচার ও ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যবাদ এখন এলোমেলো বিষয়ের উদ্বৃত্ত নুন-মশলামাখা দুর্বোধ্যতার পুরোডাশ্‌ খেয়ে নৈরাজ্যের অগ্নিমান্দ্যে ভুগছে। এখন আবার তাই ভালো ছেলে সেজে প্রথাসিদ্ধ কবিতা লেখার চেষ্টা করছি আমি।– অক্ষরের খাণ্ডবদাহন আর কি।

সঞ্জয়ঃ    তরবারি, বলা ভালো এ শতকে একটা  ICBM, যখন কলমের চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠছে বারে বারে, তখন কবির পক্ষে কি যথার্থ’ই মূল্যবান সামাজিক জীব বলে প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ আছে? আপনারা সামাজিক অবস্থানটা কী?

অনন্যঃ   দেখুন…ঐদুটো জিনিস একেবারেই আলাদা এবং স্বক্ষেত্রে ভীষণ শক্তিশালী। অস্ত্রের ক্ষতিসাধনের উপায় স্থাননির্ভর; কলমের হিতসাধনের উপায় কালনির্ভর। সুতরাং, ও দুটোর প্রতাপ নিয়ে কোনো তুলনামূলক আলোচনাই চলতে পারে না। সাহিত্যের দ্বারা বাস্তবে কখনো কখনো সামাজিক পরিবর্তন আনা যায় না; তার সাক্ষ্য বহন করা যায়— এইমাত্র। কলমের পরাক্রম একমাত্র তপন সিন্‌হার ‘এখনই’ ছবিতে দেখেছি।; তা সেরকম হাস্যকর তর্কাতর্কিতে গিয়ে লাভ কি?

         একজন সামাজিক জীব হিসেবে কবি পদার্থ বিজ্ঞানী, ক্রিকেট খেলোয়াড় বা কয়লাখনির শ্রমিকের থেকে বেশী কিম্বা কম ইম্পরটেন্ট নন। প্রত্যেকেরই সামাজিক অবদানের উপায় আলাদা। (সমাজ তো শুধু রাজনীতির আখড়া নয়! ) রবীন্দ্রনাথ গ্যারিবল্ডি, ফ্রয়েড, প্যাটারসন ও ক্লিফ রিচার্ডের মধ্যে কে বেশি ক্ষমতাবান, সেটা বিচার করব কিভাবে?... শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, সমাজসেবিকা মাদার টেরেসার থেকে চোর এবং সমকামী জঁ জেনে একজন ‘সামাজিক জীব’ হিসেবে কম মূল্যবান নন। এসব অবান্তর কথা বলছি, কেননা প্রশ্নটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম হয়তো। যদি আপনি সরাসরি জিগ্যেস করতে চান,’কবির কি কোনো রকম সামাজিক বা রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকা উচিত?’ তবে ব্যক্তিগত অন্তত, আমি বলব, ‘হ্যাঁ’ কিন্তু সোশ্যাল কমিটমেন্ট ছাড়াও যে একজন বড়ো কবি হতে পারেন না, তার প্রমাণ তো ভুরি-ভুরি। আসলে, চিন্তার স্বাধিনতা ছাড়া লেখালিখির আর কোন শর্ত নেই। আমি সাহিত্যকে মানুষের অন্তর্জগতিক স্বাধীনতা লাভের উপায় ছাড়া আর কিছু ভাবি না। যেটুকু কমিটমেন্ট তা, ঐ স্বাধীনতার কাছে! এবং সেইটুকুই সাহিত্যের সামাজিক ভূমিকা।

নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে আমি এটুকুই শুধু বলতে পারি যে: আমি একজন উচ্চবিত্ত ঘরের কপটচারী নিষ্ক্রীয় পরগাছা, যার কথাবার্তা ও ক্রিয়াসমূহের দূরত্ব অলঙ্ঘনীয় ; যার ঘটনাবিহীন দিনযাপনের অতিক্রান্ত করা লোমের আড়ালে দ্যাখা যার সারা অঙ্গের দগ্‌দগ্‌ করছে মার্কসবাদের চুলকানি, অস্তিত্বতন্ত্রের ঘা, অবস্তুতান্ত্রিকতার কুষ্ঠ! আমার সামাজিক অবস্থান, যথার্থ মধ্যবিত্তসুলভভাবেই, ঠিক ঘেয়ো কুত্তার মতো।

সঞ্জয়ঃ   ধরুন, আপনাকে যদি বলি আমাদের শতাব্দীতে আপনার প্রিয় পাঁচজন বিদেশী কবির নাম করুন। আপনি কাদের নাম করবেন?

অনন্যঃ   লোর্কা , মায়াকোভস্কি, স্যাঁ-ঝন্‌ পের্স, এলিয়ট এবং নেরুদা। করাচী কিংবা কাঠমাণ্ডুর বাসিন্দা হলে আমি জীবনানন্দ নামও করতাম। বাংলা সাহিত্যে তিনিই একজন আন্তর্জাতিক মানের কবি! মাইকেল, কিংবা রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের বিচারে তাঁরা মহাকবি হলেও, বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলেন, অন্তত ইতিহাসগতভাবে। নয় কি?

সঞ্জয়ঃ   ‘আধুনিকতা’ শব্দটা অতি ব্যাবহারে আমাদের কাছে বেশ জোলো মনে হয়। কি কি স্থানাঙ্ক দিয়ে আপনি মডার্ন সেন্সিবিলিটিকে পুরনো চিন্তা ও চেতনার চাইতে আলাদা করেন?

অনন্যঃ    আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করা আমার মাস্টারমশাই ক্রিস্টোফার কডওয়েল- এরও সাধ্য নয়! এ ব্যাপারে অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিত অনেক অনেক হেক্কার গ্রন্থ লিখেছেন এবং অস্তিত্ব জিজ্ঞাসা, নগরমনস্কতা প্রভৃতি অনেক বিশিষ্ট লক্ষণকে তাঁরা সনাক্ত করতে পেরেছেন। আমি নেহাৎই অশিক্ষিত, তাই আধুনিকতার জ্যান্ত শরীরের ওপর শব-ব্যাবচ্ছেদ চালানো আমার সমর্থের বাইরে! শুধু অত্যন্ত মামুলি, সাধারণ স্থনাঙ্ক নির্ণয় আমি এভাবেই করতে পারি যে: প্রাচীন (?) সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতো মেটাফিজিকস্‌ ; আধুনিক সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে ডায়লেটিকস। এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে আমরা আধুনিক কাব্যের জনক স্বয়ং বোদল্যেরকেই বেছে নিতে পারি। মধ্যযুগীয় কবি দান্তের পক্ষে জরুরি ছিল মানুষের পাপী পৃথিবী থেকে ঈশ্বরের সপ্রেম আশ্রয়ে পৌঁছনোর জন্য স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের বিভাজন করা; কিন্তু বোদল্যের, আধুনিক তিনি, প্রথম থেকেই জানতেন যে রক্তমাংসের বাস্তব আসলে পাপ-পুণ্য, প্রেম-ঘৃণা, বিদ্রোহ-সমর্পণ প্রভৃতি সমস্ত বিপরীতমুখী প্রবণতা যেন পরস্পর পরিপূর‍ক  হয়ে একই সঙ্গে মিশে আছে— তাদের লেবেলএঁটে আলাদা করা যায় না! একই সঙ্গে  অনেক দিক থেকে বস্তুসমূহকে গভীর তদন্ত করা, যা ঘটেছে পিকাসোর কিছু ছবিতে, হচ্ছে আধুনিকতার প্রধানতম লক্ষণ বলে আমার মনে হয়।

এ-হচ্ছে একধরনের মাইক্রো-এপিকধর্মীতা। আগে শিল্পী ছিলেন ঈশ্বরের নির্দেশক বিচারক; এখন শিল্পী হচ্ছে নর-নির্বাসিত আবিষ্কারক। (এই নির্বাসন, বলা বাহুল্য,জটিলতম শ্রমবিভাগ জাত) এই বোদল্যের স্বাভাবিকভাবেই দেখেছেন, নোংরা বস্তির মধ্যেই ভাস্বর কাপুয়া! কিম্বা দস্তয়ভস্কি পক্ষে সম্ভব হয়েছে নির্যাতিত বেশ্যার সামনে নতজানু হয়ে বসে মানবিক পবিত্রতার পুনুর্জন্ম চাওয়া।  কিম্বা জঁ জেনে বা বার্গম্যান……(এ-ব্যাপারে কথা বাড়িয়ে আর আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না।)

সঞ্জয়ঃ   কুড়িশতক শেষ হয়ে এলো, আবহমানকালে শিল্পচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে কুড়িশতকের শিল্পসাহিত্যের বিশিষ্ট ভূমিকাটা কী?

অনন্যঃ  কুড়িশতকের তো শেষ হতে এখনও ষোলো বছর বাকি এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি চর্মচক্ষে একুশ শতাব্দীর শুরু দেখে যেতে পারব, এমন ভরসা আমার নেই।তবু এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই শতাব্দীতে মানুষের যত উন্নতি হয়েছে, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রজুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে, তা গত দু হাজার বছরেও হয়নি! জ্ঞানবিজ্ঞনের প্রগতি এখন গুণগত হারে বাড়ছে। এবং মানসিকভাবে এই শতাব্দীতে শাসন করেছেন প্রধানত তিন জার্মান: মার্কস,আইনস্টাইন ও ফ্রয়েড। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এঁদের প্রভাব লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ব আমাদের চোখে দ্যাখা জগতের পরিপাটি বাস্তবতার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে। আর কখনও সম্ভব হবে না বোধহয় কেতাদুরন্ত ন্যাচারিলিস্ট রচনাশৈলীকে ‘যথার্থ বিজ্ঞানের দৃষ্টি’  বলে অভিহিত করা।   virtual particles- এর কথা ভেবে দেখেছেন কি? পরিবর্তে এখন এসেছে আপাত বিকৃতির যুগঃ Cubism, Surrealism, Futurism, Magic Realism প্রভৃতি— যেখানে বহিরঙ্গের হাবা বাস্তবতার খোলশ ছিঁড়ে শিল্পীরা তদন্ত করেছেন মানুষের আত্মার গভীরে; যুগযুগান্তরের প্রতিষ্ঠিত পুতুপুতু ‘নন্দনতত্ব’-কে আছড়ে ছত্রভঙ্গ করে গড়ে তুলছেন নতুন শিল্পরূচি, যেখানে সত্যের বীভৎস দ্যূতি আমাদের সপ্রতিভ করে। এবং সেটা কিন্তু মার্কস্‌-ফ্রয়েড-আইনস্টাইন- নির্দেশিত সড়কে আরও  ‘বৈজ্ঞানিক’ভাবেই। সংক্ষেপে এর থেকে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

এটা কি শুধুই সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের আতঙ্কের উতরোল এক বুর্জোয়া বিশৃঙ্খলা, নাকি নতুন নতুন সেন্সিবিলিটি উদ্বোধন, তা এখনই বলা যাবে না।

সঞ্জয়ঃ   শিল্প কোনো মালগাড়ি নয়, তবু শিল্পী হিসেবে আপনি কোথাও পৌঁছতে চান? আমি ইচ্ছে করেই ‘কবি’র বদলে ‘শিল্পী’ শব্দটিকে বেছে নিয়েছে, ভেবে দেখবেন।

অনন্যঃ   আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আসলে উত্তরটা লুকিয়ে আছে। তবু, পৌঁছানোর-র শব্দার্থ যদি goal কিম্বা attainment ধরা হয়, তবে তো নিশ্চয়ই বলতে হবে যে, শিল্পী হিসেবে আমরাও কিছু, আদর্শস্থানীয় লক্ষ্যস্থল আছে; যে স্তর আমি attain করতে চাই। যেমনঃ কক্‌তোর ‘অর্ফিউস’, শেকস্‌পীয়ারের ‘হ্যামলেট’ দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’, লোর্কার ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রভৃতি- আমারও কিছু প্রিয় লক্ষ্য আছে। মার্কসের ‘ছেঁড়া শ্রম’ প্রবন্ধটাই বা বাদ দিই কি করে? ভ্যানগখের ছবি, বীঠফেনের সঙ্গীত, সোফিয়া লোরেনের উরু কিম্বা ভিভ রিচার্ডের  ব্যাটিং – এইসমস্তই আমার আদর্শস্থল।

সঞ্জয়ঃ    আপনার কবিতার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ‘চুল্লির প্রহর’ এ আপনি যথেষ্ট সাহেবি ভাষার প্রয়োগ করেছেন। মনে হচ্ছে আপনার ধারণা বাংলাভাষা এখনও সাবালিকা হয়ে ওঠে নি। সেক্ষেত্রে কবি হিসেবে আপনারই কি কর্তব্য নয় ভাষাকে রজোদর্শন করানো?

অনন্যঃ    ‘চুল্লির প্রহর’-র সাহেবদের ভাষা ব্যবহার করেছিলাম কোনো ঔপনিবেশিক গোলামির থেকে নয়; আমি জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্পের ক্ষেত্রে কোনো ‘জাতীয়তাবাদে’ মানি না। ‘ভারতীয়’ কিংবা ‘বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য’ বলে যাঁরা অববরত বগল বাজিয়ে নাচছেন, তাঁদের আমি সবিনয়ে জিজ্ঞেস  করতে চাই ‘ইলেকট্রিসিটি’ বা ‘সনেট’ এর কোনটি আবিষ্কৃত হয়েছে রাজাভাতখাওয়া , এঁড়েদ কিংবা বরাকর থেকে? আসলে বাংলা ভাষার দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য মননশীলতা বিষয়ের পরিভাষার বড়ো অভাব। বাংলাভাষায় মিঠে মিঠে লিরিক লেখা চলে, আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে হরি হরি বোল বলে বুকের লোম ভিজিয়ে কাঁদা চলে, কিন্তু Systematically serious কিছু লেখা বড়ো কঠিন। তার কারণ, ওসব এদেশে কিছুই হয়নি, মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। নইলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে আমরা বৈজ্ঞানিক বানাতাম, কিম্বা ব্রজেনশীলকে দার্শনিক? আমাদের ঐতিহ্যে যেটুকু দার্শনিক মননশীলতা আছে সংস্কৃতে, কিন্তু সে ভাষা মৃত। (তার উপর আমি সেটা জানিও না একদম)। তাই মৃত ভাষার লাশ কাঁধে না করে আমি অধিকতর জ্যান্ত একটি ভাষার সাহায্য নিয়েছি, যে ভাষা ইংরেজির বদলে ল্যাটভিয়ানও হতে পারতো। ওটা কাকতালীয় আর কি। এমনিতেই তো লেনিনের রচনাবলী বাংলায় পড়ার থেকে মূল রাশিয়ান পড়া অনেক সোজা । বাংলায় প্রবন্ধকার, যাঁরা অর্থহীন উদ্ভট একটা সংস্কৃত শব্দ বসিয়ে পাশে ব্র্যাকেটে আসল ইংরেজী শব্দটা লিখে ভাবেন যে খুব বাংলা পরিভাষা লিখলাম— তাঁদের মতো নিজেকে ভ্যাঙ্গানোর ইচ্ছে ছিল না। আবহমান বাংলা সাহিত্য, যা ‘বউদি-সাহিত্য’ ছাড়া কিচ্ছু নয়, যেখানে ষণ্ডামার্কা গুঁফো মূস্কো দামড়ারা কেবল ‘রাধাভাবপ্রাপ্ত’ হয়ে রজোদর্শন করতে চায়, সেখানে, এই মননশূন্য মওগাপনার মরুভূমির মধ্যে, বাংলা ভাষাকে কী করে আমি প্রাপ্তবয়স্ক বলব? তবে, আপনার শেষ অভিযোগটির সঙ্গে আমি একমত। আমারই হয়তো উচিত ছিল  নিজের মতো ভাষা তৈরি করা ; যেটা করার প্রতিভা আমার নেই। তাছাড়া  আমি তো সরকারি অনুদানধন্য কোনো পারিভাষিক অভিধান লেখক নই! ওটা ‘আচার্য’ বা ‘গুরুদেব’দের কাজ।

আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য  আমি এলিয়ট প্রমুখ সাহেবদের উদাহরণও দিতে পারি না কি?

সঞ্জয়ঃ   আপনার সাধারণ রোজনামচা কী ?

অনন্যঃ    কিছুই নয়। মোটামুটি নানারকম নেশা করা, বই পড়া, পিউ নাম্নী এক বালিকার সাথে সহাস্য প্রেম করা এবং ক্রিকেট ও পদার্থবিদ্যা– বিষয়ে ভাবা। গান শোনা। এক লারেলাপ্পা একাকীত্বের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা। মৃত্যুর সঙ্গে খুচরো ইয়ার্কি। এবং পাশবিক আত্মগ্লানি। কবিতা লেখা, প্রায় মদ না খাওয়ার মতোই, এক অতি-অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক সাময়িক দূর্ঘটনামাত্র! আর কিছু নয়।

                   ( কবির ২৮ বছরে গৃহীত) 

Comments